ফুটন্ত এই নদীতে কিছু পড়লেই গলে যায়, রহস্যভেদ করলেন আন্দ্রে

বৃহস্পতিবার, ২৩ জুলাই ২০২০ | ২:৩০ অপরাহ্ণ

ফুটন্ত এই নদীতে কিছু পড়লেই গলে যায়, রহস্যভেদ করলেন আন্দ্রে

নদীর পানি টগবগ করে ফুটছে। ফুটন্ত এই নদীতে যা কিছুই পরুক না কেন গলে যাবে নিমিষেই। বলছি পেরুর আমাজনের ‘শানায় টিম্পিসখা’র কথা। এই জলস্রোতের নামকরণ করেছিল সূর্যদেবের উপাসক ইনকারারা। তাদের কাছে এই জলস্রোতে  সূর্যদেবের জলস্রোত।

স্পেনীয় বাহিনী, যারা ইনকা সভ্যতা জয় করার জন্য অভিযানে সামিল হয়েছিলেন, তাদের বিবরণেও আছে এই নদীর কথা। তবে কিভাবে এই নদীর পানি এভাবে ফুটতে থাকে তা নিয়ে সবসময়ই রয়েছে রহস্য। আর এই রহস্যের উদঘাটন করেছেন পেরুর ছেলে আন্দ্রে।

প্রায় টানা ১২ বছর ধরে এই নদীর অস্তিত্ব নিয়ে বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলে ছিলেন আন্দ্রে। একসময় তৈরি করেন পেরুর থার্মাল-ম্যাপ বা তাপমানচিত্র। পেরু জুড়ে বিস্তৃত জিয়ো থার্মাল বৈশিষ্ট্য তাকে বিস্মিত করে।

ধীরে ধীরে আন্দ্রে বুঝতে পারেন ফুটন্ত নদীর অস্তিত্ব আছে। এবং সে নদী সূর্যদেবের তাপে নয়। ফুটছে পৃথিবীর ভূভাগের অভ্যন্তরস্থ তাপে। নিজের চোখে রহস্যভেদ করতে ২০১১-র নভেম্বরে পেরুর মধ্য অংশে অভিযানে গেলেন আন্দ্রে।

শানায়া টিম্পিসখা নদীর নিকটবর্তী শহর হল পুকালপা। সেখান থেকে শুরু হল আন্দ্রের যাত্রা। দু’ঘণ্টা গাড়িতে, এক ঘণ্টা যন্ত্রচালিত ডিঙির পরে আরও ঘণ্টা খানেক আমাজনের কাদাপথে ট্রেকিং। তার পরে দেখা মিলল ফুটন্ত নদীর।

কিন্তু শেষ মুহূর্তেও বাধা। নদীর কাছেই আছে মায়ানটুয়াকু গ্রাম। সেই গ্রামের পুরোহিতরা নদীর কাছে যেতে দেন না বহিরাগতদের। কারণ ওই নদীর পানি তারা ব্যবহার করেন ওষুধ হিসেবে। ফলে তার হদিস রাখতে চান গোপনই।

অবশেষে পুরোহিতদের বোঝালেন আন্দ্রে। মিলল নদীর কাছে যাওয়ার অনুমতি। কিন্তু একা নয়। পুরোহিত তার সঙ্গে দিয়ে দিলেন নিজের প্রতিনিধিকে। তিনি পুরো সময় থাকলেন আন্দ্রের সঙ্গে।

ছয় মাইল লম্বা এই নদীকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে ঘন গাছের সবুজ প্রাচীর। নদীর সর্বোচ্চ গভীরতা ১৬ ফুট পর্যন্ত। উষ্ণ প্রস্রবণের মতো নিজের খেয়ালেই সে বেরিয়েছে পাথরের চাঁইয়ের ফাঁক দিয়ে। তারপর নিজের যাত্রাপথ শেষ করে সে মিশে গিয়েছে আমাজনের সঙ্গে।

নদীর জলের সর্বোচ্চ উষ্ণতা পৌঁছায় ২০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত। আন্দ্রে দেখতে পান, ধোঁয়া ওঠা ফুটন্ত সেই স্রোত বেয়ে ভেসে চলেছে প্রাণীদের ঝলসে যাওয়া দেহ। সবথেকে বীভৎস লেগেছে আন্দ্রের কাছে, মৃত প্রাণীগুলির চোখ গলে সাদা হয়ে গিয়েছে।

বিরল হলেও ফুটন্ত নদী আরও আছে পৃথিবীতে। কিন্তু সেগুলির কাছে হয় আগ্নেয়গিরি বা চৌম্বকীয় ক্ষেত্র আছে। আমাজনের শানায় টিম্পিসখা নদী থেকে নিকটবর্তী সক্রিয় আগ্নেয়গিরির দূরত্ব ৪০০ কিমি। তা ছাড়া পেরুর আমাজনে কোনও চৌম্বকীয় ক্ষেত্রও নেই।

তা হলে এই নদীর জল ফুটন্ত হল কী করে? আন্দ্রে ও তার সহকারী গবেষকদের মত, এর কারণ ভূগহ্বরের তাপমাত্রা। তাদের মতে, পেরুর আমাজন অরণ্যের এই গভীরে শিলাময় ভূভাগে চ্যুতি বা ফাটল অনেক বেশি। সেখান দিয়ে বৃষ্টির জল প্রবেশ করে ভূভাগের ভিতরে।

তার পর আবার ওই জলধারা উঠে আসে ভূভাগের উপরে। তখন তার তাপমাত্রা বেড়ে যায় কয়েকশো গুণ। অর্থাৎ জিয়োথার্মাল বা হাইড্রোথার্মাল চক্রের বিক্রিয়াই ফুটন্ত নদীর রহস্য।

নিজের অভিজ্ঞতা আন্দ্রে লিখেছেন ‘দ্য বয়েলিং রিভার: অ্যাডভেঞ্চার অ্যান্ড ডিসকভারি ইন আমাজন’ বইয়ে। তার আবেদন, ফুটন্ত নদীর বিস্ময়কে বাঁচাতে আমাজন অরণ্যে বৃক্ষনিধন বন্ধ হোক।

সূত্র: আনন্দবাজার

Development by: webnewsdesign.com