দেশের মানুষের ভয় কমলেও কমছে না সংক্রমণ

রবিবার, ২৬ জুলাই ২০২০ | ১১:৪৩ পূর্বাহ্ণ

দেশের মানুষের ভয় কমলেও কমছে না সংক্রমণ

রাস্তায় যানজট, গণপরিবহনের ভেতরে যাত্রীর ঠাসাঠাসি, ফুটপাতে জমজমাট বেচাকেনা, বিপণিবিতান, হাট-বাজার, অলিগলির চা ও ফুচকা-চটপটির দোকানে আড্ডা—এসব দেখে মনে হয় ফিরে এসেছে করোনাকালের আগের স্বাভাবিক অবস্থা। মানুষের মন থেকে যেন দূর হয়ে গেছে করোনার ভয়। জনসমাগম বেশি এমন স্থানেও স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই নেই। মাস্ক ব্যবহারকারীর সংখ্যাও যেন দিনে দিনে কমে যাচ্ছে।

এই অবস্থা দেখে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা রীতিমতো হা-হুতাশ করছেন। বারবার সতর্ক করা হলেও বেপরোয়া এমন জনচলাচল বন্ধে বা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। এ কারণেই দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিচের দিকে নামানো যাচ্ছে না বলে অভিমত জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, মানুষের মধ্যে অপ্রত্যাশিতভাবে ভয় কমে গেছে। সামনে এর ফল ভালো না-ও হতে পারে। কিছুদিন ধরে মানুষ যেভাবে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে দেশে সংক্রমণ পরিস্থিতির এমন অবনতি ঘটত না।

সর্বশেষ সরকারি হিসাব অনুসারে, গত ২৪ ঘণ্টায় (গত শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত) করোনা সংক্রমণ শনাক্তের হার ২৪.১২ শতাংশ। আর এ পর্যন্ত মোট পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ২০.০৮ শতাংশ। অর্থাৎ ১০০ জনের পরীক্ষা করলে ২০ থেকে ২৪ জনের ফলাফল পজিটিভ পাওয়া যাচ্ছে। তবে ভাইরাসটির একজন থেকে অন্যজনে ছড়ানোর হার গত কয়েক দিনের মতো এখনো ০.৯৯ শতাংশেই আছে। সংক্রমণ হারের দিক থেকে এই অবস্থাটিও খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করতে পারলেও সংক্রমণের ওই হার আরো কমে যেত।

 

অন্যদিকে সুস্থতার হারও দিন দিন বাড়ছে। গতকালের হিসাবে মোট শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৫৫.২০ শতাংশ। এ পর্যন্ত এক লাখ ২২ হাজার ৯০ জন সুস্থ হয়েছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন দৈনিক বাংলাদেশ মিডিয়াকে বলেন, ‘এখন বড় চ্যালেঞ্জ সংক্রমণের হার দ্রুত আরো নিচে নামিয়ে আনা। কিন্তু তা হচ্ছে না। বরং প্রায় আড়াই মাস ধরে একই চক্রে ঘুরছে দেশের সংক্রমণ পরিস্থিতি। তবে দ্রুত সুস্থতার হার বেড়ে যাওয়ায় ভয় কমছে। এ ছাড়া আমরা জাতি হিসেবেও এক ধরনের ভয়কে জয় করার বা স্বাধীনচেতা মানসিকতাসম্পন্ন জাতি। ফলে মানুষকে ঘরে বেশি দিন আটকে রাখা যায় না। তবে সতর্কভাবে চলাফেরা না করলে সংক্রমণ বাড়ার ঝুঁকি যেমন রয়েছে আবার সংক্রমণ আরো বেশি সময় ধরে চলার আশঙ্কাও আছে।’ তিনি বলেন, করোনায় জটিলতার মাত্রাও আগের তুলনায় কমে গেছে। বেশি বয়স্ক বা আগে থেকে জটিলতায় ভুগতে থাকা কেউ ছাড়া বেশির ভাগেরই হাসপাতালে যেতে হচ্ছে না, আক্রান্ত হওয়ার পরও ঘরে বসেই সুস্থ হচ্ছে বেশির ভাগ মানুষ—সেটাও ভয় কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। এ ছাড়া প্রথম প্রায় তিন মাস হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় যে বিশৃঙ্খলা ছিল তা কাটিয়ে এখন সরকারি ও বেসরকারি সব হাসপাতালেই কভিড ও নন-কভিড রোগী চিকিৎসার সুযোগ তৈরি হওয়ায় হাসপাতাল নিয়ে মানুষের হাহাকার কেটে গেছে। অর্থাৎ বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লে যখন-তখন হাসপাতালে যাওয়া যাবে বলেও মানুষ কিছুটা নিশ্চিত থাকতে পারছে। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে রিজেন্ট, শাহাবুদ্দিনসহ আরো কয়েকটি হাসপাতালে পরীক্ষা-চিকিৎসায় অবৈধ ও জালিয়াতির ঘটনায় মানুষের মধ্যে আস্থার সংকটও কিছুটা তৈরি হয়েছে।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট-আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন দৈনিক বাংলাদেশ মিডিয়াকে বলেন, ‘দেশে মানুষের মধ্যে করোনার ভয় কেটে যাচ্ছে বা কমে যাচ্ছে সেটা ভালো। মানুষের জীবনযাত্রা-অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক হচ্ছে। করোনা হলেই যে সবার মৃত্যু হয় না, সেটা মানুষ বুঝতে পেরেছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে মানুষ সতর্ক থাকছে না। স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। মাস্ক ব্যবহার করছে না। এ ব্যাপারে আরো বেশি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে সরকারের জায়গা থেকেই।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা দৈনিক বাংলাদেশ মিডিয়াকে বলেন, ‘দু-তিনটি মুখ্য কারণে মানুষের ভয় কেটে গেছে বলে আমি মনে করি। প্রথমত, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থায় জীবিকার তাড়নায় কর্মজীবী মানুষের পক্ষে বেশি দিন ঘরে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে মানুষ বাধ্য হয়েই বাইরে বের হচ্ছে। এ ছাড়া যেহেতু এখন বেশির ভাগ রোগীই সুস্থ হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে মৃত্যু হার ১ দশমিক ৩—এসব দেখে মানুষ অনেকটা ভরসা বা সাহস সঞ্চয় করেছে। এ ছাড়া হাসপাতালেও তো যেতে হচ্ছে না, ঘরে থেকেই প্রায় ৯৯ শতাংশ মানুষ সুস্থ হচ্ছে—এটাও মানুষকে আরো স্বস্তি দিচ্ছে।’ তিনি বলছেন, এখনো কারো কারো মধ্যে করোনা হলেও তা গোপন রাখার প্রবণতা আছে। তারা হয়তো চাকরি হারানোর ভয়ে কিংবা বাড়ি লকডাউন করার ভয়ে কাউকে বুঝতে না দিয়ে আগের মতো স্বাভাবিক চলাফেরা করছে। যদিও এই প্রবণতা মোটেই ভালো নয়। এটা অন্যদের সংক্রমিত করার ঝুঁকি বাড়ায়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রমণবিষয়ক জোনিং কার্যক্রমের কারিগরি কমিটির সদস্যসচিব জহিরুল করিম দৈনিক বাংলাদেশ মিডিয়াকে বলেন, ‘এখনো রেড জোনের সংখ্যা ১০০টির বেশি আছে। যদিও আগের গাইডলাইন পরিবর্তন করে নতুন গাইডলাইন হয়েছে। সেই সঙ্গে কোন এলাকায় কত লোক আক্রান্ত আছে, তা শনাক্তকরণে নতুন টুলস তৈরি করা হয়েছে। ফলে জোনিং সিস্টেমেও আবারও পরিবর্তন আসতে পারে।’

 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত বুলেটিনের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, দেশে কেবল সরকারি ব্যবস্থাপনাতেই শুধু করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য (কভিড-ডেডিকেটেড) ১৫ হাজার ১৮২টি সাধারণ শয্যা ও ৫৩৩টি নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) শয্যা রয়েছে। এর মধ্যে গতকাল সকাল পর্যন্ত রোগী ছিল সাধারণ শয্যায় চার হাজার ৩০২ জন ও আইসিইউ শয্যায় ২৮৩ জন। অর্থাৎ বাকি ১০ হাজার ৮৮০টি সাধারণ শয্যা ও ২৫০টি আইসিইউ শয্যা খালি পড়েছিল।

Development by: webnewsdesign.com