জালিয়াতি প্রতারক চক্রের ১৩ হোতা’কে ঢাকা ও ফদিরপুর জেলা হতে গ্রেফতার

উদ্ধার করা হয় প্রায় ১৪ লক্ষ ৮৩ হাজার টাকা ও প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রী।

রবিবার, ০৭ জুন ২০২০ | ৬:০৭ অপরাহ্ণ

 জালিয়াতি প্রতারক চক্রের ১৩ হোতা’কে ঢাকা ও ফদিরপুর জেলা হতে গ্রেফতার

বর্তমান সময়ে প্রায় প্রতিদিন অনেকেই মোবাইল ব্যাংকিং, অনলাইন মানি ট্রান্সফার, ক্রেডিট/ডেবিট কার্ড জালিয়াতির মাধ্যমে প্রতারিত হচ্ছেন। ভুলে টাকা চলে যাওয়া, লটারী জেতা, বৃত্তি পাওয়া, একাউন্ট বন্ধ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি বিভিন্ন কথা বলে এ চক্রটি ভিকটিমদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। লকডাউন ও করোনা ভাইরাস বিস্তারকালে মোবাইল ব্যাংকিং ও অনলাইন মানি ট্রান্সফার অন্যতম লেনদেনের মাধ্যম হয়ে ওঠে; তাই এরাও পরিস্থিতির সুযোগ নেওয়ার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে র‌্যাবের কাছে বেশ কয়েকটি এরূপ প্রতারণার অভিযোগ আসে। র‌্যাব এ সংক্রান্ত অভিযোগের ছায়া তদন্ত শুরু করে এবং এতদসংক্রান্ত রুজুকৃত মামলার ঘটনা অনুসন্ধান শুরু করে। র‌্যাব তার ছায়া তদন্ত অব্যাহত রাখে এবং গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করে।

 

এরই ধারাবাহিকতায় গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাব-২ এবং র‌্যাব-৮ এর যৌথ অভিযানে অদ্য ০৭ জুন ২০২০ তারিখ ০১.০০ ঘটিকা হতে ০৯.৩০ ঘটিকা পর্যন্ত ঢাকা ও ফরিদপুর (ভাঙ্গা থানা) জেলার বিভিন্ন এলাকা হতে মোবাইল ব্যাংকিং ও ডেবিট/ ক্রেডিট কার্ড এবং লটারী জালিয়াতি চক্রের সদস্য (ক) নাজমুল জমাদ্দার (১৯), পিতাঃ আরব আলী জমাদ্দার, (খ) হাসান মীর, (১৮), পিতাঃ গফুর মীর, (গ) মোঃ ইব্রাহিম মীর (১৮), পিতাঃ সোরাব মীর, (ঘ) তৌহিদ হাওলাদার (২৩), পিতাঃ শামসু হাওলাদার, (ঙ) মোহন শিকদার (৩০), পিতাঃ মৃত মোঃ আলী শিকদার, (জেলাঃ ঢাকা), (চ) পারভেজ মীর (১৮), পিতাঃ ইবাদত মীর, (ছ) সোহেল মোল্যা (২৬), পিতাঃ মৃত সৈয়দ মোল্যা, (জ) মোঃ দেলায়ার হোসেন (৩৫), পিতাঃ মৃত সিদ্দিক গাজী, (ঝ) সৈয়দ হাওলাদার (২০), পিতাঃ শামসু হাওলাদার, (ঞ) মোঃ রাকিব হোসেন (২৪), পিতাঃ মোঃ কাঞ্চন হাওলাদার, (ট) মোহাম্মদ আলী মিয়া (২৬), পিতাঃ মৃত তারা মিয়া, (ঠ) মোঃ পলাশ তালুকদার (৩৪), পিতাঃ মোঃ হোসেন তালুকদার এবং (ড) মোঃ ইমন (২৫), পিতাঃ মোঃ আবুল কালাম, থানাঃ ভাঙ্গা, জেলাঃ ফরিদপুর গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের নিকট হতে ১৪,৮৩,৪৬২ টাকা, ৩১টি মোবাইল ফোন, ২টি ল্যাপটপ, ২টি ট্যাব, ১২০টি সীম, ০১টি রাউটার এবং ০১টি টিভি কার্ড উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা তাদের অপরাধের সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত প্রদান করেছে।

 

জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, একজন মাস্টার মাইন্ড পুরো প্রতারক চক্রকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। পুরো চক্রের ৩০-৪০ জন সদস্য থাকে। মাস্টার মাইন্ড এর অধিনে ৫টি বিভিন্ন গ্রুপ কাজ করে যা নিম্নরুপঃ
(ক) হান্টার টিম;
(খ) স্পুফিং টিম;
(গ) ফেইক কাস্টমার কেয়ার;
(ঘ) টাকা উত্তোলন;
(ঙ) ওয়াচম্যান দল।

ক। হান্টার টিম ঃ এরা মূলত গ্রাহকদের মোবাইল নং ও তথ্যাদি সংগ্রহ করে মাস্টার মাইন্ডকে সরবরাহ করে থাকে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অফিসের কর্মচারী, মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট, গার্মেন্টস কর্মী, বিক্রয়কেন্দ্র, অনলাইন কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মীদের কাছ থেকে টাকার বিনিময়ে নাম্বার সংগ্রহ করে থাকে। বর্তমানে দেশের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানও পোশাক কারখানায় শ্রমিকদের বেতন দেয়া হয় অনলাইন ব্যাংকিং এর মাধ্যমে। প্রতারক চক্রটি পেশাজীবি, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, গার্মেন্টস্ কর্মীদের টার্গেট করে প্রতারণার ফাঁদ তৈরীর পরিকল্পনা করেছে।

খ। স্পুফিং টিম ঃ এ দলের সদস্যরা তথ্য প্রযুক্তির অপব্যবহারের মাধ্যমে মোবাইল নাম্বারগুলো স্পুফিং করে থাকে। স্পুফিং এর ফলে গ্রাহক প্রতারিত হয়। প্রতিটি স্পুফিং এর জন্য তারা মাস্টার মাইন্ড এর কাছ থেকে ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকা করে পায়। এছাড়াও কল ডিউরেশন অনুযায়ী আলাদা করে টাকা পেয়ে থাকে।

 

গ। ফেইক কাস্টমার কেয়ার ঃ এরাই মূলত ভুয়া কাস্টমার কেয়ার সেজে গ্রাহকের সাথে প্রতারণা করে থাকে। মাস্টার মাইন্ড নিজেই সাধারণত এই দলটির পরিচালনা করে থাকে। একজন মাস্টার মাইন্ডের অধীনে তিন থেকে পাঁচজন মূল কর্মী থাকে। প্রত্যেক কর্মীর আবার দুই জন করে সহযোগী থাকে। প্রতিটি কাস্টমার কেয়ারের ১৫-২০ জন সদস্য থাকে। সাধারণত মাস্টার মাইন্ড অথবা তাদের মধ্যে হতে একজন কাস্টমার কেয়ার সেজে গ্রাহকের সাথে কথা বলে বিভিন্ন তথ্য দেওয়া ও নেয়ার কাজ করে থাকে। কথোপোকথনের সময় কর্মী ও সহযোগীরা কেউ তথ্য লিপিবদ্ধ করে, কেউ অন্য মোবাইলে প্রাপ্ত তথ্য ইনপুট দিয়ে এ্যাকাউন্ট এর নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে থাকে। তারা সাধারণত চরের কোন নির্জন জায়গা বা গাছপালা ঘেরা নিরাপদ স্থান বেছে নেয়। কার্যক্রম পরিচালনার সময় অন্য সহযোগীরা এমনভাবে কথা বলতে থাকে যেন ফোনের অপর প্রান্ত হতে একটি অফিসিয়াল এনভারমেন্ট মনে হয়। সিন্ডিকেট মাস্টার মাইন্ড তার অর্জিত আয়ের ৫০% নিজের জন্য; কর্মী ও সহযোগীদের ৩০% দেয় এবং হান্টার টীমকে ২০%;স্পুফিং টীমকে প্রতি নাম্বারের জন্য ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকা এবং কথা বলা সময়ের মেয়াদ ভিত্তিতে টাকা প্রদান করে থাকে।

 

ঘ। টাকা উত্তোলন ঃ গ্রাহকের এ্যাকাউন্ট ট্রান্সফার হওয়ার পর সিন্ডিকেটের মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টদের মাধামে টাকা উত্তোলন করা হয়ে থাকে। ভাঙ্গা, ফরিদপুর ও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তাদের সমমান এজেন্ট রয়েছে। এভাবে প্রতারণাকৃত অর্থ কয়েকটি জায়গায় প্রেরণ এর মাধ্যমে নিরাপদ জায়গা থেকে তুলে নেয়। এ চক্রের কারো কারো আবার নামে/বেনামে এজেন্টশীপ রয়েছে। এজেন্টরা হাজারে দুইশত টাকা কমিশন পেয়ে থাকে।

 

ঙ। ওয়াচম্যান দল ঃ পুরো প্রতারণা চক্রের সাথে সম্পৃক্ত একদল ওয়াচম্যান থাকে যারা সাধারণত ছোটখাটো ব্যবসা বা দোকান চালানোর কাজে সম্পৃক্ত। এছাড়া ভ্রাম্যমাণ ওয়াচম্যানও কাজ করে। ওয়াচম্যান দলের কাজ হচ্ছে এলাকার কোন আগন্তুক বা সন্দেহ জনক কাউকে চলাফেরা করতে দেখলে তৎক্ষনাৎ হোতাকে জানিয়ে দেওয়া। ওয়াচম্যানরা ঘন্টা ভিত্তিক বা চুক্তি ভিত্তিক টাকা পেয়ে থাকে।

 

জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, প্রতারক চক্রের সদস্যদের অধিকাংশদের নির্দিষ্ট পেশা নেই। তবে গ্রাহকদের প্রতারিত করে তারা কোটি কোটি টাকা সংগ্রহ করে নামে বেনামে বাড়ী, গাড়ী, দোকান, জায়গা জমি ক্রয় করেছে। এরা সাধারণত সহযোগী/কর্মী হিসেবে কাজ করে লদ্ধ জ্ঞান হতে এক একটি সিন্ডিকেট তৈরী করে থাকে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে হতে ০৯ জনই মূল হোতা /মাস্টার মাইন্ড। তারা হলো (ক) নাজমুল জমাদ্দার (১৯), (খ) হাসান মীর (১৮), (গ) মোঃ ইব্রাহিম মীর (১৮), (ঘ) তৌহিদ হাওলাদার (২৩), (ঙ) মোহন শিকদার (৩০), (চ) পারভেজ মীর (১৮), (ছ) সোহেল মোল্যা (২৬), (জ) মোঃ দেলায়ার হোসেন (৩৫) এবং (ঝ) সৈয়দ হাওলাদার (২০)।

 

প্রতারণার পদ্ধতি ঃ কাস্টমার কেয়ারের প্রধানই মূল মাস্টার মাইন্ড। একজন মাস্টার মাইন্ড বা মূল হোতা হান্টার টিমের কাছ থেকে গ্রাহকদের নাম্বার সংগ্রহ করে স্পুফিং টিমকে দেয়। স্পুফিং টীম তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার করে কাস্টমার কেয়ারদের নাম্বার/সংস্থার নাম স্পুফিং করে থাকে। ফেইক কাস্টমার কেয়ারের সদস্যরা গ্রাহককে প্রতারিত করে বিভিন্ন এজেন্টের মাধ্যমে বা অনলাইনে কেনা কাটা করে অর্থ সংগ্রহ করে থাকে।

 

ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড প্রতারণা ঃ প্রতারক চক্র থেকে প্রথমে নির্ধারিত গ্রাহককে এসএমএস বা কল দেওয়া হলে স্পুফিং এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কাস্টমার কেয়ার এর নাম্বরটি ভেসে উঠে। তবে উল্লেখ্য যে, যদি কাস্টমার কেয়ার নাম্বারটি ১৭২৪১ হয়, তবে স্পুফিং বা কোনিং নাম্বারটি প্রদর্শিত হবে +১৭২৪১; পার্থক্য শুধু + চিহ্নের। ফলশ্রুতিতে প্রতারকরা ব্যাংকের বিভিন্ন গ্রাহকদের বিশ্বাস যোগ্যতা অর্জন করে। গ্রাহকদেরকে ক্ষুদে বার্তার মাধ্যমে লিখে পাঠানো হয় যে আপনার কার্ডটি উব-অপঃরাব হয়ে গিয়েছে, আপনি যদি কার্ডটি সচল করতে চান তাহলে ০১****** অথবা *****নধহশ@মসধরষ.পড়স যোগাযোগ করুন। যখন গ্রাহকরা প্রতারকদের কল দেয়, তখন প্রতারক চক্রটি গ্রাহকের কার্ডের উপরের ১৪ ডিজিট নাম্বারটি ও পেছনে ৩ ডিজিটের নাম্বারটি সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য কৌশলে সংগ্রহ করে নেয়। আবার কখনো কখনো কথা বলে ই-মেইলের মাধ্যমে কার্ডের ডিটেইলস পাঠানোর কথা বলে থাকে। আবার সরাসরি কল করে গোপন সকল তথ্যাদি কৌশলে সংগ্রহ করা হয়ে থাকে।

 

কার্ডের টাকা উত্তোলনের প্রক্রিয়াঃ প্রতারক চক্রটি অনলাইনের মাধ্যমে ডেবিট কার্ড/ক্রেডিট কার্ডের টাকা উত্তোলন করে থাকে। তারা সাধারণতঃ অনলাইন শপিং, ওয়ালেট রিফিল, ডলার ক্রয়, বিটয়েন ক্রয়, ৩৬০ বিট অনলাইন জুয়াসহ বিভিন্ন মাধ্যমে উক্ত টাকা কার্ড থেকে বের করে নেয়। পরবর্তীতে স্ক্রিল একাউন্টের মাধ্যমে টাকাগুলো উত্তোলন করে থাকে।

মোবাইল ব্যাংকিং প্রতারণা ঃ মূলত মোবাইল ব্যাংকিং কাস্টমার কেয়ারের নাম্বার স্পুফি করে বিভিন্ন গ্রাহকদের কল করে প্রতারণা করা হয়ে থাকে। বিভিন্ন প্রতারণার আশ্রয়ে তারা মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্ট এর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। হান্টার টিমের কাছ থেকে গ্রাহক সম্পর্কে যে তথ্য পায় তা কাজে লাগিয়ে কর্মীদের মাধ্যমে মূল প্রতারণার ফাঁদ পেতে থাকে।

 

মোবাইল ব্যাংকিং প্রতারণার প্রক্রিয়া ঃ প্রতারকরা কাস্টমার কেয়ারের নাম্বার স্পুফিং করে ফলে গ্রাহকরা +৮৮০১********/ ১৭২৪৭/+৪৫/+১২২১/ +২৩২২/+৮৭৮৮/অইঈঢ; ইঢঢঢ এই ধরণের নাম্বার থেকে গ্রাহককে ফোন করে বলে থাকে যে, অইঈ মোবাইল ব্যাংকিং থেকে বলছি, আপনার এ্যাকাউন্টটি সাময়িকভাবে বন্ধ/বাতিল করা হচ্ছে। যদি বন্ধ/বাতিল করতে না চান তাহলে তথ্য দিয়ে সহায়তা করুন কখনও কখনও সিস্টেম আপগ্রেডের কথাও বলে থাকে। কথোপকথনের কৌশলে প্রতারক চক্র মোবাইল ব্যাংকিং এ্যাকাউন্ট এর সব কোড, তথ্য/পিন নাম্বার ইত্যাদি সংগ্রহ করে এ্যাকাউন্ট নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়।

 

লটারির মাধ্যমে প্রতারণা ঃ এই চক্রটি কখনো কখনো লটারির জেতার কথা বলে প্রতারণা করে থাকে। বিভিন্ন ব্যক্তি কে ফোন করে বলে আপনি এত হাজার টাকা পুরস্কার পেয়েছেন, আপনি যদি টাকা নিতে চান তাহলে আমাদেরকে ফি বাবদ ২৫% টাকা দিতে হবে অথবা আপনি একটি টিভি পেয়েছেন। পণ্যটি আপনার ঠিকানায় পাঠিয়ে দেয়া হবে। পরিবহণ বাবদ ১৫০০ টাকা ওদেরকে পাঠিয়ে দিতে হবে। এভাবেই প্রতারণার কাজ সম্পাদন করে থাকে।

 

উপরোক্ত বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।

Development by: webnewsdesign.com