পরীক্ষা ও পাসে জোর শিক্ষার ক্ষতি করছে কি

সোমবার, ০২ মার্চ ২০২০ | ১:৪৬ অপরাহ্ণ

পরীক্ষা ও পাসে জোর শিক্ষার ক্ষতি করছে কি

শিক্ষার মূল্য উদ্দেশ্যই হলো জ্ঞান অর্জন ও মানসিক বিকাশ। যদিও দেশে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা—সবক’টি স্তরেই পরীক্ষায় ভালো নম্বর ও সনদ অর্জনই গুরুত্ব পাচ্ছে সবচেয়ে বেশি। সে আলোকে পাঠদান করেন শিক্ষকরা। পরীক্ষায় সন্তানের ভালো ফল অর্জন নিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতা রয়েছে অভিভাবকদের মধ্যেও। সবার প্রত্যাশিত ফল এনে দিতে একপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের কাছেও জ্ঞানার্জনের চেয়ে মুখ্য হয়ে ওঠে পরীক্ষার নম্বর। পরীক্ষামুখী এ শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীরা কতটুকু শিক্ষিত হয়ে উঠছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে এরই মধ্যে।

গত এক দশকে শিক্ষা খাতে বেশকিছু সংস্কারের উদ্যোগ নেয় সরকার। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের হাতেই এ সংস্কার কার্যক্রম শুরু হয়। শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, শিক্ষার প্রসারে নুরুল ইসলাম নাহিদের মূল দর্শনই ছিল সংখ্যানির্ভর। পাসের হার বৃদ্ধি, হাজার হাজার জিপিএ ৫ এবং নতুন নতুন স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন এগুলোই ছিল তার সময়ে শিক্ষা খাতের অর্জন। যদিও শিক্ষক প্রশিক্ষণ, শিক্ষার্থীদের দক্ষতা, গবেষণা সর্বোপরি শিখন-শেখানোর বিষয়টি সবচেয়ে অবহেলিত ছিল সে সময়।

২০০৮-২০১৮ দুই মেয়াদে টানা ১০ বছর দেশের শিক্ষা খাতের নেতৃত্ব দেন নুরুল ইসলাম নাহিদ। এ সময়ে শিক্ষা খাতে নানা উদ্যোগ নেন তিনি। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রশংসনীয় উদ্যোগ ছিল বছরের প্রথম দিন উৎসব করে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিতে পারা। তবে বইয়ের বিভিন্ন পাঠ্য নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠায় দফায় দফায় সংশোধন আনা হয়েছে বিভিন্ন শ্রেণীর বইয়ে। এতে বিভিন্ন সময়ে বিপাকে পড়তে হয়েছে শিক্ষার্থীদের।

দেশে সৃজনশীল পদ্ধতির শুরুও নুরুল ইসলাম নাহিদের হাত ধরেই। তবে পর্যাপ্তসংখ্যক শিক্ষককে প্রশিক্ষণ না দেয়ায় সৃজনশীল পদ্ধতি দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে খোদ শিক্ষকদের কাছেই। প্রস্তুতি ছাড়াই সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করায় পাঠদানে একধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, যা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা। সৃজনশীল পদ্ধতি চালুর প্রায় এক দশক পর ২০১৮ সালে করা সরকারের এক জরিপে দেখা যায়, ৪৩ শতাংশ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এখনো সৃজনশীল পদ্ধতি বোঝেন না।

সংখ্যায় গুরুত্ব দিতে গিয়ে পরীক্ষার সংখ্যাও বাড়ানো হয় নুরুল ইসলাম নাহিদের সময়। যদিও তখন অষ্টম শ্রেণীতে পাবলিক পরীক্ষায় বিরোধিতা করে বেশির ভাগ অংশীজনই। এর পরও জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষার প্রচলন করেন তিনি। এ উদ্যোগের ভালোর চেয়ে মন্দ দিকই বেশি। জেএসসি ও জেডিসি চালুর ফলে কোচিং ও নোট-গাইডের বাণিজ্য বেড়ে গেছে। পাশাপাশি পরীক্ষায় ফেল ও পড়ার খরচ চালাতে না পেরে নিম্ন মাধ্যমিকে বেড়েছে ঝরে পড়ার হার।

শুধু তা-ই নয়, পরীক্ষায় ভালো করার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় মহামারী আকার ধারণ করে প্রশ্নফাঁস। ২০১৮ সালের এসএসসি পরীক্ষায় ১২টি বিষয়ের ১১টিতেই প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ ওঠে। ওই সময় শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগেরও দাবি ওঠে।

যদিও শিক্ষার মান নিশ্চিতের জন্য করা শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে তেমন কোনো উদ্যোগ নেননি নুরুল ইসলাম নাহিদ। এমনকি ধীরগতির কারণে তৈরি করতে পারেননি শিক্ষা আইন। যদিও শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে জরুরি ছিল শিক্ষা আইন প্রণয়ন। এসব বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ।

তবে শিক্ষানীতির বেশির ভাগ সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়া প্রসঙ্গে পিকেএসএফের চেয়ারম্যান ও জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির কো-চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বণিক বার্তাকে বলেন, শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক শিক্ষায় অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত একীভূতকরণের ক্ষেত্রে বেশকিছু করণীয় নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল। আমরা ২০১১ সাল থেকেই এর বাস্তবায়ন শুরুর কথা বলেছিলাম। সেসব পদক্ষেপ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া সময়মতো শুরু করা হয়নি। সে সময় শুরু করলে এতদিনে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হতো। এছাড়া শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে একটি কমিটি করা হলেও অদৃশ্য কারণে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। মনিটরিংয়ের জন্য কোনো বডি একনিষ্ঠভাবে কাজ না করলে কোনো নীতিরই সফল বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।

পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাটা পরীক্ষামুখী হয়ে পড়ায় স্কুল-কলেজে সে আলোকে পাঠদান করেন শিক্ষকরা। পরীক্ষামুখী পাঠদানের বিষয়টি উঠে এসেছে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন গবেষণায়। দেশের মাধ্যমিক স্তরে পরীক্ষা ও এর প্রভাব নিয়ে ২০১৮ সালে একটি গবেষণা করে নিউজিল্যান্ড ও বাংলাদেশের একটি গবেষক দল। এতে নেতৃত্ব দেন নিউজিল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব ক্যানটারবুরির স্কুল অব টিচার এডুকেশনের শিক্ষক জ্যানিনকা গ্রিনউড ও মো. আল আমিন নামের এক গবেষক। গবেষণার অংশ হিসেবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ২১৬টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে জরিপ চালান তারা। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জরিপে প্রাপ্ত ফলের ভিত্তিতে ‘দ্য এক্সামিনেশন সিস্টেম ইন বাংলাদেশ অ্যান্ড ইটস ইমপ্যাক্ট: অন কারিকুলাম, স্টুডেন্টস, টিচার্স অ্যান্ড সোসাইটি’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন তারা। প্রতিবেদনটি সম্প্রতি জার্মানভিত্তিক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান স্প্রিঞ্জারে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, জরিপে অংশ নেয়া ৬৭ শতাংশ শিক্ষক গবেষক দলকে জানান, অধ্যক্ষ ও প্রধান শিক্ষক কর্তৃক তাদের বলা হয়, যে পদ্ধতিতে পড়ালে শিক্ষার্থীর ভালো নম্বর নিশ্চিত হবে সেভাবে পড়ান। ৭১ শতাংশ শিক্ষক জানান, সন্তানরা পরীক্ষায় যেন ভালো নম্বর পায় সেটি নিশ্চিত করতে বলেন অভিভাবকরা। ৮০ শতাংশ শিক্ষক বলেন, শিক্ষার্থীরা প্রত্যাশা করে যেসব বিষয় পরীক্ষায় কমন আসার সম্ভাবনা বেশি, সেগুলোই যেন ক্লাসে পড়ানো হয়। কর্তৃপক্ষ, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের এসব নির্দেশনা ও প্রত্যাশা প্রভাবিত করছে পাঠদান পদ্ধতিকে। ৫৭ শতাংশ শিক্ষক বলেন, তারা ক্লাস লেকচার তৈরি করার সময় পরীক্ষার বিষয়টি মাথায় রাখেন। এছাড়া ৬৫ শতাংশ শিক্ষকই মনে করেন, পরীক্ষা না থাকলে তাদের পাঠদান পদ্ধতি ভিন্ন হতো।

শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলেছেন, পরীক্ষামুখী পাঠদান দুর্বল করছে দেশের শিক্ষার ভিত। এর ফলে শিক্ষার মূল লক্ষ্য থেকে অনেক দূরে সরে গেছে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এসএম হাফিজুর রহমান বলেন, শিখন-শেখানোর একটি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেই পাঠ্যবই লেখা হচ্ছে। সেটি বিদ্যালয়ে পাঠদান দেয়া শেষে দেখা যায় শিক্ষার্থীরা যা শেখার তা শিখছে না। তাহলে ধরে নিতে হবে, পাঠদান পদ্ধতিতে কোনো সমস্যা হচ্ছে। পাঠদান পদ্ধতির সমস্যা হচ্ছে ক্লাসে শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যক্রম অনুযায়ী পাঠদান দেয়া হচ্ছে না। যে টপিক যেভাবে পড়ানোর কথা, শিক্ষকরা তা অনুসরণ করছেন না। আবার অনেক শিক্ষক নিজেই পাঠ্যবইয়ের বিষয়টি অনুধাবন করতে পারেন না। তাই শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যক্রম অনুসরণে শিক্ষকদের সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষকদের পাঠদানের যোগ্যতা বাড়াতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

এদিকে সম্পূর্ণ পাঠ্য না পড়ানোর ফলে এক ধরনের খণ্ডিত জ্ঞান নিয়েই বের হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। ফলে পাস করে বের হওয়ার পরও মৌলিক অনেক বিষয়ে দুর্বলতা থেকে যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের। মাধ্যমিক শিক্ষায় বিষয়ভিত্তিক শিখন মান যাচাইয়ে ‘লার্নিং অ্যাসেসমেন্ট অব সেকেন্ডারি ইনস্টিটিউশনস’ (লাসি) শীর্ষক জরিপটি চালানো হয় সরকারের পক্ষ থেকে। মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে শিখন মান কেমন, তা যাচাইয়ে সর্বশেষ ২০১৫ সালে একটি জরিপ চালায় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। দেশের ৩২ জেলার ৫২৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর পরিচালিত ওই জরিপে দেখা যায়, অষ্টম শ্রেণীর অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থীর বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে দক্ষতা কাঙ্ক্ষিত মানের নয়।

গত এক দশকে দেদার অনুমোদন দেয়া হয়েছে নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগই গুণগত উচ্চশিক্ষার তুলনায় সনদনির্ভর শিক্ষা চালু করে। গবেষণার বদলে পাঠদান ও সনদনির্ভর উচ্চশিক্ষার প্রসার ঘটতে থাকে। এমনকি সনদ বাণিজ্যেও জড়িয়ে পড়ে বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয়। যদিও এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নিশ্চিতে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়মে প্রশ্রয় দেয়ার অভিযোগ রয়েছে সাবেক শিক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে। দেদারসে খোলার অনুমোদন দিলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম বন্ধে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেননি নুরুল ইসলাম নাহিদ। উল্টো বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটা অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) সুপারিশ করলেও তা আমলে নেয়া হয়নি।

ইউজিসির একজন সাবেক চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে নানা অনিয়ম ধরা পড়ত। আমরা সেগুলো বন্ধে ব্যবস্থা নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠাতাম। একটি ঘটনা ছিল এমন, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় অনিয়মের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়টি বন্ধের সুপারিশ করে ইউজিসি। পরে দেখা যায়, তত্কালীন শিক্ষামন্ত্রী তাদের সমাবর্তনে গিয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন। আরো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম স্থগিত করে তা বন্ধ করার জন্য সুপারিশ করা হলে উল্টো স্থগিতাদেশ তুলে নেয়ার জন্য চিঠি দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

গত কয়েক বছরে দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়লেও মান বাড়েনি। বিশ্ববিদ্যালয় র্যাংকিংয়ে জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান কুয়াকুয়ারেলি সাইমন্ডস (কিউএস)। যুক্তরাজ্যভিত্তিক গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানটির ২০১২ সালের জরিপে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশ্বিক অবস্থান ছিল ৬০১তম। ২০১৮ সালে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ৭০১তম। অর্থাৎ আট বছরের ব্যবধানে কিউএস র্যাংকিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ১০০ ধাপ অবনমন হয়েছে। একইভাবে গবেষণা, উদ্ভাবন ও সমাজের ওপর প্রভাব—বিজ্ঞান গবেষণায় এ তিনটি বিষয়কে ভিত্তি ধরে শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তালিকা করে স্পেনের সিমাগো ল্যাব ও যুক্তরাষ্ট্রের স্কপাস। সিমাগো ইনস্টিটিউশনস র্যাংকিংস (এসআইআর) নামে নিয়মিত প্রকাশিত এ জরিপে ২০১২ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বৈশ্বিক অবস্থান ছিল ৭২৫তম। এসআইআর ২০১৯-এ বুয়েটের অবস্থান ৭৫৬তম। সে হিসাবে সাত বছরের ব্যবধানে ৩১ ধাপ অবনমন হয়েছে বুয়েটের। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েট নয়, মানের দিক থেকে গত কয়েক বছরে নিম্নগামী অবস্থানে রয়েছে দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়। কিউএস, টাইমস ও স্কপাসের মতো স্বীকৃত বৈশ্বিক র্যাংকিংগুলোতে ক্রমান্বয়ে নিচের দিকে নামছে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান। স্নাতক সম্পন্ন করেও বেকার থাকছে গ্র্যাজুয়েটদের বড় অংশ। শিক্ষকদের শিক্ষকতার মান নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করছে খোদ শিক্ষার্থীরাই। গবেষণায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান খুবই নাজুক। সব মিলিয়ে গত এক দশকে মানের দিক থেকে দেশের উচ্চশিক্ষা খাতের তেমন কোনো অর্জন নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, সংখ্যায় বাড়লেই সেটিকে উন্নয়ন বলা যাবে না, শিক্ষার উন্নয়ন ঘটাতে হবে মানে। সে অর্থে গত এক দশকে দেশের শিক্ষা খাতে তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে মান কমেছে। শিক্ষার্থীদের ওপর পরিচালিত বিভিন্ন ধরনের অ্যাসেসমেন্ট ও সূচকেও একই ধরনের চিত্র উঠে আসে। শিক্ষার মানোন্নয়ন কিংবা মান নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে সবার আগে প্রয়োজন যোগ্য ও প্রশিক্ষিত শিক্ষক। এক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় দুর্বলতা রয়েছে। শিক্ষক নিয়োগে রাজনৈতিকীকরণ, ঘুষসহ বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায়। এ ধরনের অনিয়ম বর্জনীয়। এছাড়া সৃজনশীল চালু করা হলেও শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হয়নি। তাই শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও সামাজিক মান-মর্যাদা বৃদ্ধির মাধ্যমে মেধাবীদের এ পেশায় আকৃষ্ট করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থায় পরীক্ষাকেন্দ্রিকতা আরো বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সব মনোযোগ পরীক্ষায়, শিক্ষায় নয়। এ সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

সম্প্রতি শিক্ষার মানোন্নয়নে জোর দিচ্ছে সরকার। এরই মধ্যে পরীক্ষার চাপ কমিয়ে আনতে ২০২১ সাল থেকে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত সব ধরনের পরীক্ষা বাতিলের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। প্রথম থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত কারিকুলামে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে সরকার। এ পরিবর্তনে আসলে নবম শ্রেণী থেকে বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিক বিভাগ বিভাজন আর থাকবে না। সবাইকে একই কারিকুলামের একই পাঠ্যবই পড়তে হবে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীও মাধ্যমিক পর্যন্ত বিভাজন না রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন। শিক্ষার মান উন্নয়নে সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণের কথা জানিয়েছেন তিনি।

শিক্ষা খাতের সার্বিক বিষয় নিয়ে বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, সৃজনশীল নিঃসন্দেহে একটি ভালো পদ্ধতি। তখন আরেকটু প্রস্তুতি নিয়ে শুরু করলে আরো ভালো হতো। তবে এটিও দেখতে হবে, ওই সময় শুরু করার কারণেই এখন সেটি বাস্তবায়নে কাজ করতে পারছি। এছাড়া শিক্ষানীতি ও আইন—এসব ক্ষেত্রে একই কথা। তখন শুরু হয়েছিল বলেই এখন আমরা সেগুলো বাস্তবায়নে কাজ করতে পারছি। একসময় আমাদের লক্ষ্য ছিল শিক্ষার প্রসার। আসলে সেটি ছিল প্রথম ধাপ। সেটি সম্পন্ন হয়েছে। এখন শিক্ষার মান উন্নয়নে যা যা করা দরকার, সব উদ্যোগ নেয়া হবে।

Development by: webnewsdesign.com