‘বস পাগল’ থেকে যেভাবে বেস্ট টিমে উত্থান হয় মোস্তাফিজের!

মঙ্গলবার, ০১ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ৯:১৬ অপরাহ্ণ

‘বস পাগল’ থেকে যেভাবে বেস্ট টিমে উত্থান হয় মোস্তাফিজের!

মাদকসেবন, প্রতারণা, ব্লাকমেইল, মানুষের সম্মানহানী ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করে অর্থ আদায় করার পাশাপাশি ফেসবুক লাইভে সুবিচার প্রতিষ্ঠার নামে বাইকে পুলিশের হুইসেল বাজিয়ে জেলাব্যাপী দাপিয়ে বেড়ানো দেবহাটার বস পাগলখ্যাত বিতর্কিত বেস্ট টিমের অ্যাডমিন মোস্তাফিজুর রহমানের কাছে গোটা জেলার মানুষ অত্যাচারিত।

কোন প্রশাসনিক কিংবা সরকারি সংস্থার প্রতিনিধি বা গণমাধ্যমকর্মী না হয়েও নিজেকে একজন বড়মাপের অফিসার আঙ্গিকে জনসম্মুখে জাহির করে ফেসবুক লাইভে মানুষের মাঝে ত্রাস সৃষ্টি করে চলছিলেন সদ্য গ্রেপ্তার হওয়া মাদকাসক্ত ও বস পাগল মোস্তাফিজুর রহমান।

বিতর্কিত বেস্ট টিমের ফেসবুক পেজ থেকে লাইভে থাকাকালীন যেকোন ঘটনার ঘটনাস্থলেই রীতিমতো আদালত বসিয়ে তদন্তের মানুষকে হয়রানী এবং নিজেদের মনগড়া সিদ্ধান্তকে বিচারিক আদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সাতক্ষীরার সাধারণ মানুষকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিলেন মাদকাসক্ত মোস্তাফিজুর রহমান ও তার স্ত্রী সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের সদস্য এ্যাড. শাহনেওয়াজ পারভীন মিলি।

যেকোন ঘটনায় তাদের ফেসবুক লাইভে উপস্থাপনা থাকে আইনের উদ্ধের কোন ব্যাক্তি হিসেবে। তারা হলেন ফেসবুক বেইজড গ্রুপ বেস্ট টিমের এডমিন পরিচয়দানকারী মাদকাসক্ত মোস্তাফিজুর রহমান ওরফে বস পাগল এবং তার স্ত্রী শাহনেওয়াজ পারভীন মিলি।

সাম্প্রতিক সময়ে সাতক্ষীরার এক অসহায় ট্রলি চালকের ঘরের তালা ভেঙে লুটপাট ও ভাঙচুরের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার আসামী হিসেবে মঙ্গলবার রাত দেড়টার দিকে সাতক্ষীরা শহরের বাসা থেকে মোস্তাফিজুর রহমান ও তার স্ত্রী মিলিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

পরে মোস্তাফিজুর ও শাহনেওয়াজ পারভীন মিলিসহ আরো তিনজনকে আসামী করে আইসিটি অ্যাক্টে সাতক্ষীরা সদর থানায় আরেকটি মামলা দায়ের করেন সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের সদস্য মাহফুজা খাতুন রুবি। পাশাপাশি মোস্তাফিজুর রহমানের ডোপ টেস্টে মাদকাসক্তের বিষয়টি প্রমানিত হওয়ায় পুলিশের পক্ষ থেকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রন আইনে আরো একটি মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে।

 

এদিকে মঙ্গলবার তাদেরকে আদালতে সোপর্দ করা হলে কোন আইনজীবি তাদের পক্ষে জামিনের আবেদন না করায় অবশেষে সন্ধ্যায় তাদের দুজনকে কারাগারে প্রেরন করা হয়। তবে আদালতে নেয়ার সময় নিজেকে বাঁচাতে অসুস্থতার ভান করেন শাহনেওয়াজ পারভীন মিলি।

এদিকে গ্রেপ্তারের পর সাতক্ষীরা দাপিয়ে বেড়ানো মাদকাসক্ত মোস্তাফিজ ও তার স্ত্রী মিলির সম্পর্কে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে নানা তথ্য।

মোস্তাফিজের জন্ম দেবহাটা উপজেলার ভাতশালা গ্রামে। কিন্তু বেশ কয়েক বছর আগে বিভিন্ন কারনে ভাতশালা থেকে পরিবার সহ কুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ এলাকায় চলে আসে মোস্তাফিজ। সেখানে আসার পর পারিবারিক ভাবে বিয়ে করে সে। রয়েছে ১২ বছরের এক কন্যা সন্তানও।

ছোট থেকেই হেরোইন ও পরবর্তীতে ইয়াবার নেশায় আসক্ত ছিলো মোস্তাফিজ। কিন্তু কুলিয়ায় আসার পর ক্রমশ মোস্তাফিজের হেরোইন ও ইয়াবার নেশা তীব্র আকার ধারন করে। নেশার টাকার জন্য বিভিন্ন সামাজিক অপরাধ ও এলাকার মানুষকে অতিষ্ঠ করে তোলে সে। মাত্রাতিরিক্ত নেশা করায় একদিকে পাগলপ্রায় এবং অন্যদিকে কুলিয়ার নেশার জগতের বস হয়ে ওঠে মোস্তাফিজ।

মুলত সেজন্য কুলিয়া এলাকায় বস পাগল নামে পরিচিত হয়ে ওঠে সে। হয়ে ওঠেন অনেকের নেশার জগতের গুরু। নেশা করতে গিয়ে বহুবার ধরা ও সাবেক চেয়ারম্যান আসাদুল হকের কাছে পিটুনি খেয়ে রেহাই পায় মোস্তাফিজ। একপর্যায়ে এলাকা থেকে বিতাড়িত হয় সে। পরবর্তীতে সাতক্ষীরা জেলা পরিষদ সদস্য ও আইনজীবি এক সন্তানের জননী শাহনেওয়াজ পারভীন মিলিকে দ্বিতীয় বিয়ে করে সাতক্ষীরায় বসবাস শুরু করে মোস্তাফিজ। কৌশলে ডিভোর্স দেয় প্রথম স্ত্রীকে, ফেলে যায় ফুটফুটে কন্যা সন্তানকেও।

বছর খানেক আগে মোস্তাফিজ মিলিকে সাথে নিয়ে ফেসবুকে একটি গ্রুপ খুলে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ সহ সমাজের অনিয়ম বন্ধের নামে মোটর বাইকে পুলিশের হুইসেল বাজিয়ে জেলার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত দাপিয়ে বেড়াতে শুরু করে। বনে যান বেস্ট টিমের অ্যাডমিন। এমনকি অসহায় মানুষকে সহযোগীতার নামে বিভিন্ন প্রবাসীদের থেকে টাকা সংগ্রহ করতে থাকে। কিন্তু নামমাত্র এসব কু-কর্ম দেখে বেশ কিছু সদস্যরা মুখ ফিরিয়ে নিতে থাকে বেস্ট টিম থেকে। সংগঠন থেকে চলে আসা ব্যক্তিদের হুমকি ও হয়রানি করতে শুরু করে বস পাগল মোস্তাফিজ। তার সংগঠনে থাকা নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক কয়েকজন জানান, ভালো কাজের নামে মানুষকে হয়রানি, ব্লাকমেইল করে অর্থ আদায় ছিল মোস্তাফিজের মুল কাজ। যে কারণে তারা সংঠন ছাড়তে বাধ্য হন।

কিন্তু তার সংগঠন ছাড়ার পর পুলিশ সহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভয় দেখিয়ে তাদেরকে হয়রানি ও প্রাণনাশের হুমকি দেয় সে। এমনকি তাদের একজন প্রবাসী সদস্যকে দেশে ফিরলে বিমানবন্দর থেকে অপহরণ ও গুম করে দেওয়ারও হুমকি দেয় মোস্তাফিজ।
ধুরন্ধর বসপাগল মোস্তাফিজ নিজেকে বাঁচাতে প্রশাসনের উচ্চপদাস্থ কর্মকর্তাদের মিথ্যা ও ভুল বুঝিয়ে নিজের অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছিলেন। আর এসব অনৈতিক কর্মকান্ডে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করতে থাকে নিজের স্ত্রী শাহনেওয়াজ পারভীন মিলিকে। জেলার বিভিন্ন স্থানে তদন্তের নামে শুরু করে নানা অপকর্ম।

মহামান্য হাইকোর্টের রায় মোতাবেক ধর্ষনের ভিকটিম বা নির্যাতিত নারীর নাম, ছবি কিংবা পরিচয় মিডিয়ায় প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও, মোস্তাফিজ নিজের ক্ষমতা জাহির করতে এবং ফেসবুকে জনপ্রিয়তা পেতে লাইভে ওইসব নির্যাতিতা ভিকটিম নারীদের সরাসরি লাইভ ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে দিতে থাকে। এমনকি যেকোন মানুষকে সরাসরি লাইভে সম্মানহানী করতেও পিছুপা হতোনা মোস্তাফিজ। বহু জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক ব্যক্তি, সাধারণ মানুষ এমনকি সংবাদকর্মীদেরও ফেসবুকে সম্মানহানী করতো সে। আয়ের কোন উৎস্য না থাকলেও বিলাশবহুল জীবন যাপন, দামি গাড়ি, ও একাধিক সুন্দরী অবিবাহিতা নারীদের নিয়ে ঘুরে বেড়াতো মোস্তাফিজ।

 

এই মাদকাসক্ত বস পাগল মোস্তাফিজের ফেসবুক লাইভে সম্মানহানীর শিকার হয়েছেন কালিগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান সাঈদ মেহেদী, জেলা পরিষদ সদস্য আল ফেরদৌস আলফা, দেবহাটা উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও নওয়াপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান মুজিবর রহমান, জেলা আওয়ামীলীগের কোষাধ্যক্ষ ও সাবেক কুলিয়া ইউপি চেয়ারম্যান আছাদুল হক, জেলা পরিষদের সদস্য মাহফুজা খাতুন রুবি ও সাতক্ষীরার একাধিক সাংবাদকর্মী থেকে শুরু করে প্রবাসী, কলেজ ছাত্র সহ অসংখ্য মানুষ।

Development by: webnewsdesign.com