বিগত দুই যুগ পরেও ক্ষতিপূরণ আদায় হয়নি কমলগঞ্জের মাগুরছড়া ট্র্যাজেটির।

রবিবার, ১৪ জুন ২০২০ | ৩:৩৬ অপরাহ্ণ

বিগত দুই যুগ পরেও ক্ষতিপূরণ আদায় হয়নি কমলগঞ্জের মাগুরছড়া ট্র্যাজেটির।

কমলগঞ্জের মাগুরছড়া ট্র্যাজেটি দিবস। ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন মধ্যরাত মাগুরছড়া গ্যাসকূপে বিস্ফোরণের প্রচন্ড শব্দে কেঁপে ওঠে ছিল গোটা কমলগঞ্জ । আগুনের লেলিহান শিখায় লাল হয়ে উঠেছিল মৌলভীবাজার জেলার সুনীল আকাশ।

ভীত-সন্ত্রস্থ লোকজন ঘরের মালামাল রেখে প্রাণ ভয়ে ছুটে ছিল দিগি¦দিক। প্রায় ৫০০ ফুট উচ্চতায় লাফিয়ে উঠা আগুনের লেলিহান শিখায় লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল বিস্তীর্ণ এলাকা। আগুনের শিখায় গ্যাসফিল্ড সংলগ্ন লাউয়াছড়া রিজার্ভ ফরেষ্ট, মাগুরছড়া খাসিয়াপুঞ্জি, জীববৈচিত্র্য, বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন, ফুলবাড়ী চা বাগান, সিলেট-ঢাকা ও সিলেট- চট্টগ্রাম রেলপথ এবং কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল সড়কে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়।

দেশের ইতিহাসে ভয়াবহতম অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ঘনগভীর বন ও এর সাহচর্যে থাকা বিপুল সংখ্যক প্রাণীবেচিত্র্য। ক্ষতির মুখোমুখি হয় রেল ও সড়কপথ, পানজুম, বিদ্যুৎ লাইনসহ এই অঞ্চলের অসংখ্য স্থাপনা।

দুর্ঘটনার জন্য দায়ী মার্কিন গ্যাস উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান অক্সিডেন্টাল ক্ষয়ক্ষতির আংশিক পরিশোধ করলেও কোন ক্ষতিপূরণ পায়নি বন বিভাগ। ফিরে আসেনি প্রাকৃতিক বনের স্বাভাবিকতা।

পূর্ণ ক্ষতিপূরণ না দিয়েই ইউনিকলের কাছে হস্তান্তরের পর সর্বশেষ শেভরনের কাছে বিক্রি হয়েছে এই গ্যাসক্ষেত্র।

শেভরন ২০০৮ সালে ওই বনে ত্রি-মাত্রিক ভূতাত্ত্বিক জরিপ কাজ সম্পন্ন করে । এতেও স্থানীয়ভাবে অনেকেই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। ২০১২ সনে শেভরন মৌলভীবাজার ১৪নং ব্লকের অধীনে নূরজাহান, ফুলবাড়ি এবং জাগছড়া চা বাগানের সবুজ বেষ্টনি কেটে কূপ খননের পর এসব কূপ থেকে চা বাগানের ভেতর দিয়ে ড্রেন খনন করে পাইপ লাইনের মাধ্যমে উত্তোলিত গ্যাস কালাছড়ার মাধ্যমে রশীদপুর গ্রীডে স্থানান্তর চলছে ।

মাগুরছড়া ট্র্যাজেডির ২৩ বছরেও জনসম্মুখে ক্ষয়ক্ষতির তালিকা প্রকাশ হয়নি, আদায় হয়নি ক্ষতিপূরণ। পরিবেশ সংরক্ষণবাদীদের তথ্য মতে, ৬৩ প্রজাতির পশু-পাখির বিনাশ সাধন হয়। সিলেটের সঙ্গে সারাদেশের রেলযোগাযোগ ১৬৩ দিন বন্ধ থাকে।

মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছিল ১৫ হাজার কোটি টাকা। মার্কিন অক্সিডেন্টাল ক্ষয়ক্ষতির আংশিক পরিশোধ করলেও বন বিভাগ কোন ক্ষতিপূরণ পায়নি । ফিরে আসেনি এখনো প্রাকৃতিক বনের স্বাভাবিক পরিবেশ। পূর্ণ ক্ষতিপূরণ না দিয়েই ইউনিকলের কাছে হস্তান্তরের পর সর্বশেষ শেভরনের কাছে বিক্রি করেছে।

শেভরন ২০০৮ সালে ওই বনে ত্রি-মাত্রিক ভূতাত্ত্বিক জরিপ কাজ সম্পন্ন করে। এতেও স্থানীয়ভাবে অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ২০১২ সনে শেভরন মৌলভীবাজার ১৪ নং ব্লকের অধীনে নূরজাহান, ফুলবাড়ি এবং জাগছড়া চা বাগানের সবুজ বেষ্টনি কেটে কূপ খননের পর এসব কূপ থেকে চা বাগানের ভেতর দিয়ে ড্রেন খনন করে পাইপ লাইনের মাধ্যমে উত্তোলিত গ্যাস কালাছড়ার মাধ্যমে রশীদপুর গ্রীডে স্থানান্তর চলছে।

বিভিন্ন সংগঠন মাগুরছড়া দুর্ঘটনার যথাযথ ক্ষতিপূরণ আদায়ের দাবিতে আন্দোলন পরিচালনা করে এলেও দীর্ঘ ২৩ বছরেও ক্ষতিগ্রস্তদের দাবিকৃত ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিষয়টি এখনো অমীমাংসিত রয়েছে।

গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের কারণ অনুসন্ধানের জন্য গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আজ পর্যন্ত জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি । তৎকালীন সরকার ক্ষতিপূরণ আদায়ের জোরালো ভূমিকা পালন করেনি । ফলে মাগুরছড়া দুর্ঘটনার ২৩তম বার্ষিকী পূর্ণ হলেও ক্ষতিপূরণ আদায় নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার কারণে আজো ক্ষতিপূরণ না পেয়ে ক্ষতিগ্রস্তরা নিরবে চোখের জল ফেলছে।
এ নিয়ে মৌলভীবাজার তথা সিলেটের জনমনে ক্ষোভের আগুন জ্বলছে।

গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের পরিত্যক্ত এলাকার উত্তর টিলায় সবুজায়ন করা হয়েছে । মূল কূপটি এখনো পুকুরের মতো ধারণ করে টিকে আছে । চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরী করা হয়েছে । টিলার ওপর সবুজ বনায়নের উদ্যোগ নিলেও মাঝে মধ্যে আগুনের পোড়া ডালপালাবিহীন কালো রঙের গাছগুলো অগ্নিকান্ড দুর্ঘটনায় সাক্ষী এখনো দাঁড়িয়ে আছে।

দীর্ঘ ২৩ বছরেও বাংলাদেশ মাগুরছড়া গ্যাসক্ষেত্র বিস্ফোরণের তদন্ত প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করতে পারেনি । তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে মাগুরছড়া বিস্ফোরণে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১৪ হাজার কোটি টাকা । অক্সিডেন্টাল, শেভরন কি ইউনোকল কোনো বহুজাতিক কোম্পানির কাছ থেকেই এই ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারেনি রাষ্ট্র।

মার্কিন নানা বহুজাতিক কোম্পানির মাধ্যমে এই সব নিপীড়ন সংঘটিত হলেও আবারও প্রশ্নহীন কায়দায় মার্কিন সরকারের সহায়তায় এই বনভূমিতেই চালু হয়েছিল নিসর্গসহায়তা প্রকল্প । তার ধারাবাহিকতায় আইপ্যাক কর্মসূচি এবং বর্তমানে ক্রেল প্রকল্প চলছে । নিসর্গ, আইপ্যাক ও ক্রেল কী করেছে? পরিবেশ সংরক্ষণ ও প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষার নামে লাউয়াছড়া বনকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে।

নির্দয়ভাবে সংরক্ষিত বনাঞ্চলে চালু করেছে বাণিজ্যিক পর্যটন । ১৯৯৭ সাল থেকে ঘটে চলা লাউয়াছড়া বনের ওপর নানা বিচারহীন বহুজাতিক আঘাত সমূলে ঢেকে ফেলছে। বাণিজ্যিক পর্যটনের নামে জনগণের স্মৃতি থেকে লাউয়াছড়ার ওপর লাগাতার বহুজাতিক জখমের দাগ মুছে দিতে একের পর এক উন্নয়ন-উন্মাদনা তৈরি করছে।

নতুনভাবে শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ বাংলাদেশের এক ব্যস্ত পর্যটন অঞ্চল হয়ে উঠেছে। লাউয়াছড়া-মাগুরছড়া এই পর্যটনের এক অবশ্য গন্তব্য ও দর্শনীয় স্থান। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে মাগুরছড়া বিস্ফোরণের স্মৃতি জোর করে মুছে দেওয়া হচ্ছে।

কমলগঞ্জ উপজেলার সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভিতরে লাউয়াছড়া ফরেষ্ট বিটের অভ্যন্তরে মাগুরছড়া এলাকায় ১৯৮৪-৮৬ ও ১৯৯৪ সালে সাইসলিক সার্ভেতে গ্যাস মজুদের সন্ধান পাওয়া যায়। এ প্রেক্ষিতে উৎপাদন ভাগাভাগির চুক্তিতে ১৯৯৫ সালের ১১ জানুয়ারী মার্কিন বহুজাতিক তেল ও গ্যাস উত্তোলণকারী কোম্পানী অক্সিডেন্টালের সাথে বাংলাদেশ সরকারের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং গ্যাস উত্তোলনের জন্য ৬৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে অনুমতি প্রদান করা হয়।

দায়িত্ব গ্রহণের পর অক্সিডেন্টাল কোম্পানী মাগুরছড়ায় গ্যাস ফিল্ডের ড্রিলিং কাজের জন্য সাবলিজ প্রদান করেছিল ডিউটেক নামের জার্মান কোম্পানীর কাছে। গ্যাস উত্তোলনে ১৪ নং ব্ল¬¬কের মাগুরছড়াস্থ মৌলভীবাজার-১ গ্যাসকূপের খননকালে ৮৫০ মিটার গভীরে যেতেই ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন মধ্য রাতে ঘটে ভয়াবহ বিষ্ফোরণ।

এ সময় শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ ১৫ কিঃমিঃ (৩৩ হাজার কেভি) উচ্চতাপ বৈদ্যুতিক লাইন পুড়ে নষ্ট হয় । কুলাউড়া, বড়লেখা ও কমলগঞ্জ উপজেলার ৫০ টি চাবাগানে দীর্ঘদিন স্থায়ীভাবে বিদ্যুৎ সংকট দেখা দেয়। ৬৯৫ হেক্টর বনাঞ্চলের বৃক্ষ সম্পদ, পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের ব্যাপক ক্ষতি হয়।এছাড়া ২৪৫ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পুড়ে নষ্ট হয়, যার বাজার মূল্য দাঁড়ায় ৫০ কোটি ডলার ।

গ্যাস বিস্ফোরনের পর অক্সিডেন্টাল তাদের সহোদর ইউনোকলের কাছে দায়িত্ব দিয়ে এ দেশ ত্যাগ করলে দুই বছর পর ফুলবাড়ি চা বাগান, পার্শ্ববর্তী মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জির বাড়ি-ঘর, পান জুম এলাকার ক্ষয়ক্ষতি বাবদ আংশিক টাকা প্রদান করে ইউনোকল।

অন্যদিকে দূর্ঘটনাস্থলের কাছাকাছি কমলগঞ্জ শ্রীমঙ্গল সড়ক ধারে সামাজিক বনায়নের রোপিত গাছের জন্য ৩ ব্যক্তিকে ১০ লাখ টাকা ক্ষতি পূরণ প্রদান করা হয় । দীর্ঘ ৬ মাস কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকার কারণে ক্ষতি পূরণ বাবত বাস মালিক সমিতিকে ২৫ লাখ টাকা প্রদান করা হয় ।

এ ছাড়াও বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে কিছু ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে। কিন্তু পরিবেশ ও গ্যাস বাবত কোন ক্ষতিপূরণ করা হয়নি এবং কোন সরকারই ক্ষতিপূরণ আদায়ে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় জনমনে সন্দেহ বিরাজ করছে ।

দুর্ঘটনার পর তৎকালীন সরকারের খনিজ ও জ্বালানী মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাহফুজুল ইসলামকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তদন্ত কমিটি ১৯৯৭ সালের ৩০ জুলাই মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট পেশ করে । তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী অক্সিডেন্টালের দায়িত্বহীনতাকেই দায়ী করা হলেও রহস্যজনক কারণে ক্ষতিপূরণ আদায়ের বিষয়টি অমিমাংশিত রয়েছে ।

আলাপকালে বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আব্দুল ওয়াদুদ সাংবাদিকদের বলেন, মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের পর বনের ক্ষতি নিরূপন করে দেয়া হলে এ পর্যন্ত কিছুই পাওয়া যায়নি । প্রাকৃতিক বনের ক্ষতি কোন সময়ে পুষিয়ে উঠার নয়।

Development by: webnewsdesign.com