সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর একাশি বছর পূর্ণ হলো

বুধবার, ০২ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ১:০৭ অপরাহ্ণ

সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর একাশি বছর পূর্ণ হলো

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার যুদ্ধ হিসেবে বর্ণনা করা হয়ে থাকে। পহেলা সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শূরুর একাশি বছর পূর্ণ হলো।

উল্লেখ্য যে, ১৯৩৯ সালের এক সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়েছিলো। এই যুদ্ধটি মানব সভ্যতার জন্য বেদনাদায়ক ও কলঙ্কময় কালো ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে।প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানীর লজ্জাজনক পরাজয় ও পরিণতি এবং ভার্সাই চুক্তির মধ্যদিয়ে বেদখল হয়ে যাওয়া জার্মানির কথিত ভূখন্ড পূনরুদ্বার করার অজুহাতে কোনোরূপ পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই ১৯৩৯ সালের এক সেপ্টেম্বর ভোর ৪.৪৫ ঘটিকায় জার্মানি পোল্যান্ডের ওপর সামরিক হামলা ও অভিযান শুরুর মধ্যদিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করেছিলো। ১.৫ মিলিয়ন জার্মান নাজি বাহিনী একযোগে একই সময়ে পোল্যান্ডের ১৭৫০ মাইলব্যাপী সীমান্তে সকলধরণের মারণাস্ত্র নিয়ে সর্বাত্মক হামলা পরিচালনা করে হাজার হাজার ঘুমন্ত মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করেছিলো। লেখক, কলামিস্ট এবং ইতিহাসবিদ ক্রিস্টোফার কেলিন জার্মান বাহিনীর পোল্যান্ড আক্রমণ সম্পর্কে বলেন, তারা উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিক থেকে স্থল, নৌ ও আকাশ পথে একযোগে হামলা করেছিলো।পোল্যান্ডের ওপর জার্মান নাজি বাহিনীর অতর্কিত হামলা সহজে গ্রহণ করতে পারেনি পোল্যান্ডের দুইমিত্রদেশ ব্রিটেন ও ফ্রান্স। দেশদুটি ভয়াবহ পরিণতির হুমকি দিয়ে অবিলম্বে পোল্যান্ড থেকে জার্মান বাহিনীর প্রত্যাহার ও যুদ্ধ বন্ধের আহবান জানিয়ে জার্মান সরকারকে আল্টিমেটাম প্রদান করে। এই আল্টিমেটাম জার্মান কর্তৃপক্ষের দ্বারা প্রত্যাখ্যানই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ হয়ে ওঠেছিলো।জার্মান কর্তৃক যুদ্ধ বন্ধের এবং পোল্যান্ড থেকে নাজিবাহিনী প্রত্যাহার করতে অস্বীকৃতির প্রেক্ষাপটে ১৯৩৯ সালের তিন সেপ্টেম্বর ব্রিটেন ও ফ্রান্স একযোগে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। পোল্যান্ডের ওপর নাজিবাহিনীর অনাকাক্সিক্ষত আক্রমণের মধ্যদিয়ে বিশ্বসভ্যতা ও মানবসমাজের জন্য যে দুঃখময় ও বেদনাদায়ক পরিণতির সূচনা ঘটেছিলো তার সমাপ্তি হয়েছিলো ছ’বছর পরে ১৯৪৫ সালের দুই সেপ্টেম্বর। এই বিশ্বযুদ্ধে ত্রিশটি রাষ্ট্রের প্রায় একশো মিলিয়ন মানুষ সরাসরি জড়িত ছিলেন। এই বিশ্বযুদ্ধে কতসংখ্যক মানুষ নিহত হয়েছিলেন তার সঠিক পরিসংখ্যান জানা না গেলেও প্রায় নব্বই মিলিয়ন মানুষ নিহত হয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়। কয়েক মিলিয়ন মানুষ শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এবং পঙ্গুত্ববরণ করেছিলেন।এই যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের সশস্ত্র বাহিনীর বারো মিলিয়ন সদস্য ও সতের মিলিয়ন বেসামরিক নাগরিকসহ মোট উনত্রিশ

মিলিয়ন মানুষ নিহত হয়েছিলেন,যা দেশটির মোট জনসংখ্যার চৌদ্দ শতাংশ। পোল্যান্ড তার মোট জনসংখ্যার ষোল শতাংশ বা পাঁচ দশমিক আট মিলিয়ন সামরিক-বেসামরিক লোক হারিয়েছিলো।যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অন্যান্য দেশের মধ্যে সামরিক-বেসামরিক মিলে আমেরিকার চার লাখ তের হাজার লোক নিহত হয়েছিলো। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অন্যান্য দেশেরও অসংখ্য সামরিক-বেসামরিক লোক নিহত-আহত হয়েছিলেন। এই যুদ্ধে প্রায় দুই ট্রিলিয়ন ডলার অর্থ ব্যয় হয়েছিলো বলে মনে করা হয়। প্রাপ্ত তথ্যমতে, এই যুদ্ধে দুটি পক্ষ জার্মান নেতৃত্বাধীন অক্ষশক্তি এবং এর প্রতিপক্ষ মিত্রবাহিনী অংশ নিয়েছিলো।অক্ষশক্তির মূল রাষ্ট্রগুলো ছিলো, এডলফ হিটলারের নেতৃত্বাধীন জার্মানী, বেনিতো মুসোলিনির ইতালি ও জাপান। মিত্রশক্তির প্রধান রাষ্ট্রগুলো ছিলো, ব্রিটেন, ফ্রান্স, আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন।

এই উভয়পক্ষের প্রায় ত্রিশ মিলিয়ন সশস্ত্রবাহিনীর সদস্য যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন।প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সাথে তুলনা করলে দেখা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বেসামরিক লোক নিহত হয়েছিলেন সবচেয়ে বেশি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মোট বেসামরিক লোক নিহত হয়েছিলেন পাঁচ শতাংশ এবং সশস্ত্রবাহিনীর সদস্য নিহত হয়েছিলেন পঁচানব্বই শতাংশ। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বেসামরিক লোক নিহত হয়েছিলেন সাতষট্টি শতাংশ এবং সশস্ত্রবাহিনীর সদস্য নিহত হয়েছিলেন তেত্রিশ শতাংশ। পরিসংখ্যান প্রমাণ করে যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জয়ের জন্য নিরীহ বেসামরিক মানুষই আক্রমণ ও হত্যাকান্ডের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন।মানব সভ্যতার উদ্ভবের পর থেকেই দেখা যায়, প্রতিটি সংঘটিত যুদ্ধেই নিরীহ বেসামরিক মানুষ বলিদানের শিকার হয়েছিলেন,-এটিই হলো যুদ্ধের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রধান ঘটনা হলো, আমেরিকার পারমাণবিক বোমার আবিষ্কার এবং মিত্রশক্তির পক্ষে অক্ষশক্তির জাপানের ওপর আমেরিকার পারমাণবিক বোমার ব্যবহার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি পর্যায়ে এসে আমেরিকা অক্ষশক্তির জাপানের হিরোসিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করেছিলো। পারমাণবিক বোমার ব্যবহার যুদ্ধের মোড় যেমন ঘুরিয়ে দিয়েছিলো, জাপানের পরাজয় ও আত্মসমর্পণ নিশ্চিত করেছিলো, তেমনি পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থার জন্য ভয়ংকর পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা উসকে দিয়েছিলো। এই যুদ্ধ শেষে পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থায় ব্রিটেন ও ফ্রান্সের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী নাজি জার্মানির পরাজয়ের পর পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেছিলো সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন। যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহ, অর্থ্যা ব্রিটেন, ফ্রান্স ও আমেরিকার সাথে সোভিয়েত ইউনিয়ন মিত্রশক্তি গঠন করে জার্মানীর নেতৃত্বাধীন অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলো এবং যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নেরই ক্ষতি হয়েছিলো সবচেয়ে বেশি।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির বিজয়ের পরে বিশ্বব্যবস্থায় আদর্শভিত্তিক বিভক্তি এসেছিলো এবং দু’টি বিশ্বশক্তির উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছিলো। এর একদিকে ছিলো আমেরিকার নেতৃত্বে পুঁজিবাদী বিশ্ব এবং অন্যদিকে ছিলো সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃ ত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব।আদর্শগত এই বিভক্তির মধ্যদিয়ে বিশ্বব্যবস্থায় শুরু হয়েছিলো নতুন এক যুদ্ধ, যা শীতলযুদ্ধ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ যুদ্ধজয়ী বিশ্বনেতারা অঙ্গীকার করেছিলেন, বিশ্বকে মানুষের জন্য নিরাপদ আবাসনের উপযোগী করে তোলার জন্য এবং যুদ্ধমুক্ত পৃথিবী প্রতিষ্ঠার জন্য যা কিছু করণীয় তার সবকিছু করা হবে।

পৃথিবীর মানুষ আর কখনো যুদ্ধ দেখবে না, যুদ্ধের বলি হবে না, এমনটাই বলেছিলেন বিশ্বনেতারা।বিশ্বনেতাদের এই আশাবাদের প্রেক্ষিতে একটি শান্তিপূর্ণ বিশ্বব্যবস্থা গড়ার লক্ষ্যকে সামনে রেখে বিশ্বযুদ্ধের শেষে ১৯৪৫ সালে গঠন করেছিলেন, জাতিসংঘ। তবে এই বিশ্ব সংস্থাটির সফলতা নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। বিশেষকরে, যুদ্ধমুক্ত নিরাপদ পৃথিবী প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জাতিসংঘ সফল হতে পারেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী এই দীর্ঘ একাশি বছরে বিশ্বব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন এসেছে সত্য, কিন্ত যুদ্ধমুক্ত পৃথিবীর প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। এই দীর্ঘ সময়কালে পৃথিবীর নানা প্রান্তে যুদ্ধ, খন্ডযুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। আর এরজন্য বলিদান হচ্ছেন নিরীহ মানুষ।১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বরের বেদনাময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর ক্ষণটি তাই মানবসভ্যতার জন্য অভিশপ্ত হয়ে আছে এবং থাকবে।
(অ্যাডভোকেট আনসার খান)
লেখক : আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক।কপি-

Development by: webnewsdesign.com