“বাঘ পাগল ছিলেন টিপু সুলতান”

বুধবার, ০২ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ৩:৫৯ অপরাহ্ণ

“বাঘ পাগল ছিলেন টিপু সুলতান”
ছবি: সংগৃহীত

বাঘ পাগল ছিলেন টিপু সুলতান। ভেড়া বা শিয়ালের মতো দুইশ বছর বাঁচার চেয়ে বাঘের মতো দুইদিন বেঁচে থাকাও ভালো’। টিপু সুলতান এমনটিই বলতেন। তার রাজ্যের প্রতীক ছিল বাঘ। এই বাঘ ছিল তার অনুপ্রেরণার উৎস। নিজেও বাঘের ন্যায় ক্ষীপ্রতা অর্জন করে সবার কাছে অনুকরণীয় হয়েছিলেন। তার রাজ্যের পতাকায় কানাড়ি ভাষায় লেখা ছিল ‘বাঘই ঈশ্বর’। তিনি সিংহাসনে বসে মাঝে মাঝেই এ কথাটি বলতেন।
১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজ সেনাপতি হেক্টর মুনরোর ও তার বাহিনীর কাছে দ্বিতীয় মহীশূর যুদ্ধে টিপু ও তার বাবা মারাত্মক নাজেহাল হন। টিপুর রাজ্যে যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়, নিহত হয় অনেক সৈন্য। এমনিতেই তিনি প্রচণ্ড ইংরেজ বিরোধী ছিলেন। তদুপরি এই পরাজয়ে তিনি আরো বেশি তেজদীপ্ত হয়ে ওঠেন। ঘটনাক্রমে ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে হেক্টর মুনরোর একমাত্র পুত্র সুন্দরবনের সাগর দ্বীপে শিকার করতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে নিহত হন।এই সংবাদ শুনে টিপুর মাথায় এক বুদ্ধি খেলে যায়। তিনি এই ধারণা কাজে লাগিয়ে একটি বিচিত্র খেলনা বানিয়েছিলেন। যা সারা দুনিয়ায় টিপু’স টাইগার নামে বিখ্যাত হয়ে আছে। আজো এই নিদর্শন রয়েছে। ফরাসি যন্ত্রকুশলীদের দ্বারা নির্মিত প্রমাণ আকারের এই খেলনাটিতে ক্লকওয়ার্ক সিস্টেম ব্যবহৃত হয়েছিল। খেলনাটিতে দম দিয়ে ছেড়ে দিলে এর সঙ্গে লাগনো একটি অর্গান পাইপ থেকে রক্ত হীম করা বাঘের প্রচণ্ড গর্জনে চারপাশ যেন কম্পিত হত! আর এক ইংরেজের প্রচণ্ড গোঙানির আওয়াজ বের হতো।পুরো খেলনাটির ধরন ছিল- একজন ইংরেজ একটি বাঘের থাবার মধ্যে অসহায়ভাবে পড়ে গোঙাচ্ছে আর একটা বাঘ প্রচণ্ড আওয়াজ করে সেই ইংরেজের বুকের উপর চেপে গলা কামড়ে ধরেছে। তখন ইংরেজ তার হাত উঠিয়ে চেষ্টা করতো বাঘের মাথাটি এদিক-ওদিক সরাতে। এসময় খেলনার মধ্য দিয়ে মহীশূর সুলতানের প্রিয় গজলের সুর বাজত। টিপু’স টাইগার তৈরির পিছনে তার দুইটি কারণ ছিল- ইংরেজদের প্রতি রাগ ও ক্ষোভ এবং ব্যঘ্রপ্রীতি। খেলতে খেলতে টিপু যখন হাঁপিয়ে উঠতেন তখন বাঘটিও দম নিত! কখনো রাতের পর রাত একই জিনিস দেখে গায়ের জ্বালা মেটাতেন টিপু সুলতান।

বাঘের ন্যায় সিংহাসন বানালেন…
ছোটবেলা থেকেই টিপু বাঘের গল্প শুনতে ভালোবাসতেন। বাবা হায়দার আলীই তাকে বাঘের গল্প শোনাতেন। কিশোর বয়স থেকেই টিপু সুলতান বাঘ পুষতে শুরু করেন। বাঘ নিয়েই ছিল তার যত ভালো লাগা। বাবার মৃত্যুর পর তিনি রাজ্যভার নিলেও পুরনো কাঠামোর সিংহাসন পছন্দ করলেন না। তাই তিনি তৎকালীন শ্রেষ্ঠ কারিগর দিয়ে কাঠের ফ্রেমের উপর সোনার পাত বসিয়ে তার উপর মণি-মুক্তা ও রত্নখচিত একটি সিংহাসন বানিয়ে নিলেন। যা এখন ব্যাঘ্রাসন (টাইগার থ্রোন) নামেই পরিচিত। কারণ আট কোণা ওই আসনটির ঠিক মাঝখানে ছিল একটি বাঘের মূর্তি। ৮ ফুট চওড়া আসনটির রেলিংয়ের মাথায় বসানো ছিল সম্পূর্ণ স্বর্ণের তৈরি দশটি বাঘের মাথা। আর উপরে উঠার জন্য ছিল দুইধারে রূপার তৈরি সিঁড়ি। আর পুরো ব্যাঘ্রাসনটাই ছিল বাঘের শরীরের মতো ডোরাকাটা।
টিপুর পোশাক এমনকি ব্যবহার্য সব কিছুতেই ছিল বাঘের ছাপ…
টিপু সুলতানের সমস্ত পরিধেয় পোষাক ছিল হলুদ-কালো রঙে ছাপানো। যা দেখতে ছিল অনেকটা বাঘের শরীরের মতো ডোরাকাটা। তিনি যে তলোয়ার ব্যবহার করতেন, তার গায়েও ছিল ডোরা দাগ এবং হাতলে ছিল খোদাই করা বাঘের মূর্তি। তার ব্যবহৃত রুমালও ছিল বাঘের মতো ডোরাকাটা। এছাড়াও তার রাজ্যের সমস্ত সৈনিকের পোষাকে থাকতো বাঘের ছবি। সৈন্যদের ব্যবহার্য তলোয়ার, বল্লম, বন্দুকগুলোর নল, কুদো, হ্যামারেও আঁকা থাকতো বিভিন্ন আকারের বাঘের প্রতিরূপ কিংবা মূর্তি। এমনকি তিনি তার রাজ্যের প্রধান প্রধান সড়কের পাশে, বাড়ির মালিকদেরকে বাড়ির দেয়ালে বাঘের ছবি আঁকার নির্দেশ জারি করেছিলেন।

ঘরের সামনে বাঁধা থাকত বাঘ-
এরপরও তার বাঘ পোষার বাতিক যায়নি এবং রাজবাড়িতে বেশ কয়েকটি পোষা বাঘ ছিল। তার কয়েকটি আবার তার ঘরের দরজার সামনে বাঁধা থাকতো। এজন্যই টিপু সুলতানকে ডাকা হতো শের-ই-মহীশূর। তার এই উপাধিটা ইংরেজদেরই দেয়া। টিপুর এই বাঘ বা শের হয়ে ওঠার পিছনে অনেকগুলো বিষয় সম্পর্কিত ছিল। মূল কারণ ছিল তার অসাধারণ ক্ষীপ্রতা, দক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা আর কৌশলপূর্ণ রাজ্য পরিচালনা- বাবার সুযোগ্য উত্তরসূরী ছিলেন টিপু সুলতান। টিপু সুলতানই বিশ্বের প্রথম রকেট আর্টিলারি এবং বিভিন্ন অস্ত্র তৈরি করেছিলেন। তিনি তার শাসনকালে বেশ কয়েকটি প্রশাসনিক উদ্ভাবন চালু করেছিলেন। একটি নতুন মুদ্রা ব্যবস্থা এবং ক্যালেণ্ডারসহ একটি নতুন ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা যা মহীশূরের রেশম শিল্পের বিকাশের সূচনা করেছিল। টিপু সুলতান ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে যুদ্ধে ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ৪ মে নিহত হন।শ্রীরঙ্গপত্তনম যুদ্ধে টিপু সুলতান তার কাছের মানুষদের ষড়যন্ত্রে এবং কিছু কৌশলের ব্যর্থতার কারণে।

Development by: webnewsdesign.com