চীনের মতলব জানতে হবে, চীনের ফাঁদে যেন না পড়ি

শনিবার, ২৯ আগস্ট ২০২০ | ৯:০৬ অপরাহ্ণ

চীনের মতলব জানতে হবে, চীনের ফাঁদে যেন না পড়ি
সুপ্রীম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

শৈশবে কুফা নামে একটি গ্রামীণ শব্দের সাথে পরিচিত হয়েছিলাম। শব্দটির অর্থ অমঙ্গলকর। সম্ভবত “কু” অর্থাৎ অমঙ্গলকর থেকেই এই শব্দের উৎপত্তি। আগস্ট মাসটির বেলায় এই কুফা শব্দটি খুবই প্রযোজ্য। এ মাসেই আমাদের জাতির জনক, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালিকে হত্যা করেছিল একাত্তরের পরাজিত স্বাধীনতা বিরোধীরা। এ মাসেই একই পরাজিত অপশক্তি গ্রেনেড ছুঁড়ে চেষ্টা করেছিল বঙ্গবন্ধু কন্যা বিশ্বনন্দিত নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে। তিনি সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন। কিন্তু প্রাণ হারিয়েছিলেন প্রয়াত মহামান্য রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান সাহেবের স্ত্রী আইভী রহমানের মতো নিবেদিত মানুষসহ মোট ২৪ জন নিরাপরাধ মানব সন্তান।

এ মাসেরই ৬ এবং ৯ তারিখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে পারমানবিক বোমা ফেলে লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষ হত্যা করেছিল। এই অমঙ্গলকর আগস্ট মাসের শেষ দিনটি অর্থাৎ ৩১ তারিখটিও আমাদের জাতীয় জীবনে একটি কালো দিবস, কেননা বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ১৬ দিনের মাথায় এই দিনে চীন প্রথমবারের মতো বঙ্গবন্ধুর খুনি তথাকথিত সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল পাকিস্তানের কথায়। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম বিরোধী শক্তি চীন বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে অনেকটা তড়িঘড়ি করে খুনিদের স্বীকৃতি দেওয়া থেকে আঁচ করা স্বাভাবিক যে চীন সম্ভবত বঙ্গবন্ধুর হত্যা এবং পরবর্তীতে একটি পাকিস্তানি সৃষ্ট সরকারের জন্যই অপেক্ষা করছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় চীন ভারতীয় সীমান্তে প্রচুর সৈন্য মোতায়েন করেছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নস্যাত করার জন্য। কিন্তু চীন তা পারেনি কারণ তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন চীন সীমানায় কয়েক হাজার সেনা পাঠিয়ে চীনকে রুখে ছিল। ইয়াহিয়া, ভুট্টো চীনের আশায়ই ছিল এবং প্রকাশ্যেও তাই বলতো। কিন্তু সোভিয়েতরা সে গুড়ে বালি ঢেলেছিল। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান চীনে তৈরি বুলেট দিয়েই আমাদের ৩০ লক্ষ শহীদকে হত্যা করেছে।

 

শুধু তাই নয়, আমাদের স্বাধীনতার পরেও চীন নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হয়ে তার নব্যপ্রাপ্ত ভেটো ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে বাংলাদেশের জাতিসংঘে প্রবেশের পথ রুদ্ধ করে রেখেছিল। আজও চীন বিশ্বময় একটি আগ্রাসী জাতি হিসেবে পরিচিত। সমুদ্র সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তিসমূহ লংঘন করে সে দক্ষিণ চীন সাগর এবং সেখানকার কয়েকটি দ্বীপ দখলের চেষ্টায় লিপ্ত যার জন্য ঐ অঞ্চলের ২০টি দেশের সাথে তার যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে আর এসব দেশের মধ্যে রয়েছে সমাজতান্ত্রিক ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ব্রুনাই, অস্ট্রেলিয়া প্রমুখ।

আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এ সাগর এবং সাগর তলের সম্পদ সব দেশের সম্পদ হওয়াও বিশ্বের সব দেশ চীনের এই আগ্রাসী ভূমিকার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। চীন, তাইওয়ান, কমুনিস্ট রাষ্ট্র ভিয়েতনাম এবং ভুটানের অংশ বিশেষ দখলেরও পাঁয়তারা করছে বিধায় এই দেশগুলো শংকিত। অতীতে বেআইনিভাবে তিব্বত দখল করেছে। ১৯১৪ সালে সিমলা চুক্তির সৃষ্টি ম্যাক মেহোন লাইন ভঙ্গ করে সম্প্রতি ভারত আক্রমণ করে কয়েকজন ভারতীয় সৈন্য হত্যা করেছে। তদুপরি করোনাভাইরাসের ব্যাপারে, যেটি তাদের দেশেই শুরু, বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে এ রোগে বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর সংখ্যা বাড়িয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এসব কারণে চীন আজ বন্ধুবিহীন একটি দেশ। এক পাকিস্তান ছাড়া এর কোনো মিত্র নেই।

গ্রাম্য মহাজনদের মতো চীন গরিব দেশগুলোকে ঋণ জালে জর্জরিত করে এমনকি ঋণগ্রস্ত দেশের ভূমি পর্যন্ত নিয়ে নিচ্ছে। শ্রীলঙ্কার হাম্বান টোটা বন্দর ৯৯ বছর লিজে দখল নেওয়া তারই উদাহরণ। এভাবে আফ্রিকান রাষ্ট্র জিবুতিতে গড়ে তুলেছে সামরিক ঘাঁটি। সম্প্রতি শ্রীলংকার নতুন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রকাশ্যেই বলেছেন হাম্বান টোটা বন্দর চীনের কাছে ইজারা দেওয়া ছিল একটি ভুল সিদ্ধান্ত। যদিও নামে কমিউনিস্ট, এটিকে বর্তমানে মার্কসবাদের কোনো সজ্ঞায়ই ফেলা যায় না।

এটি আজ বিশ্বের শীর্ষ পুঁজিবাদী দেশসমূহের অন্যতম। সেখানে রয়েছে আলিবাবা, হোয়াওয়ে প্রভৃতি বিশ্বের শীর্ষ ব্যক্তি মালিকানা কোম্পানি এবং জ্যাকমা, মা স্টোটেনের মতো বিশ্বের শীর্ষ ধনকুবের। এটি প্রাক্তন সোভিয়েতের মতো আদর্শবাদী দেশ নয়, বরং একটি আগ্রাসী দেশ, যে দেশটি ১৯৭৯ সনে ভিয়েতনামের মতো দেশ আক্রমণ করেছিল, যে দেশ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং রক্ষার জন্য বহু বছর সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হয়েছিল।

চীন-পাকিস্তান করিডোরের নামে পাকিস্তানের গিলগিট এবং গুয়েদার এলাকার বহু জায়গা তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে, যার জন্য পাকিস্তান পার্লামেন্টের উচ্চ পরিষদ, সিনেটের একটি কমিটির চেয়ারম্যান চীনকে নতুন ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি বলে আখ্যায়িত করেছেন। বাংলাদেশের বিষয়ে চীন যে সত্তর দশকের নীতি থেকে সরে যায়নি তার এক সাম্প্রতিক প্রমাণ মিললো গত ১৫ই অগাস্ট। দিনটি জাতীয় শোক দিবস। অথচ সেই দিনের পবিত্রতা লংঘন করে চীন খালেদা জিয়ার তথাকথিত জন্ম দিবসে উপহার পাঠিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকে অবমাননা করেছে। চীন একটি বিতর্কিত তথাকথিত জন্ম দিনকে উপহার পাঠানোর মাধ্যমে স্বীকৃতি দিয়ে কূটনৈতিক সুবিধা সংক্রান্ত ভিয়েনা কনভেনশন লংঘন করেছে। তাছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে পাকিস্তান প্রেমি দলগুলোই যে এখনো চীনের প্রিয় তা প্রমাণ করছে। আজ আমাদের দেশে সবচেয়ে বড় সমস্যা রোহিঙ্গাদের নিয়ে।

অথচ এই সমস্যা জিইয়ে রাখছে চীন। বিষয়টি যতবার নিরাপত্তা পরিষদে উঠেছে ততবারই চীন মিয়ানমারের পক্ষে ভেটো দিয়ে সমাধানের পথ রুদ্ধ করেছে। আজও চীন যদি রোহিঙ্গা বিষয়ে মিয়ানমারকে সমর্থন বন্ধ করে, তাহলে কালই মিয়ানমার বাধ্য হবে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে। এখানে চীনের বিরাট স্বার্থ কাজ করছে। রাখাইন এলাকা, যেটি রোহিঙ্গাদের আবাস ভূমি, চীন সেখানে তার “রোড অ্যান্ড ওয়ান বেল্ট” প্রোগ্রামের জন্য ঘাঁটি তৈরি করছে বিধায় তার চাই জনশূন্য রাখাইন। চীন যে আমাদের দেশে ঘুষ বাণিজ্যে প্রসারিত করছে তারও প্রমাণ সম্প্রতি মিলেছে।

ঢাকা-চট্টগ্রাম ৪ লেইন রাস্তার জন্য যে চীনা কম্পানিকে চুক্তি দেওয়া হয়েছিল (চায়না হারবাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি), উক্ত কম্পানির সংশ্লিষ্ট সচিবকে কয়েক হাজার ডলার ঘুষ দেওয়ার চেষ্টা করলে বিরল সততার সেই সচিব বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের নজরে আনেন। অতঃপর সেই কম্পানিকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। গত ১৯ আগস্ট মার্কিন সরকার বাংলাদেশের চীনের এই ঘুষ বাণিজ্যের কথা উল্লেখ করেছেন এবং সেই সাথে এ কথাও উল্লেখ করেছেন যে, চীনা কম্পানিগুলো কোকোর সাথেও ঘুষ বাণিজ্যে করেছে।

মার্কিন সরকার আরো অভিযোগ করেছে যে, চীনা কম্পানিগুলো শ্রীলংকা, কেনিয়া এবং ফিলিপাইনেও ঘুষ বাণিজ্য এবং প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন এবং শ্রীলংকার হাম্বান টোটা বন্দর প্রকল্পের কাজও তারা ঘুষ এবং প্রতারণার মাধ্যমেই পেয়েছিল। চীন এবং পাকিস্তান কৌশলে এখন বাংলাদেশের বন্ধু সাজার চেষ্টা করছে।

যারা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অপশক্তি তারা আনন্দিত হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের চেতনার ধারক, মুজিব আদর্শের সৈনিক তাদের কিন্তু সাবধান থাকতে হবে। চীন-পাকিস্তানের আসল উদ্দেশ্য জেনে নিতে হবে। বিজ্ঞজনেরা বলেন, ইতিহাস বিচার করেই ভবিষ্যতের পথ ধরতে হয়। এ কথা চীনের ব্যাপারে বিশেষভাবে প্রযোজ্য কেননা চীনে ৭০ দশকে যারা শাসক ছিল এখনো তারাই ক্ষমতায়। তাদের নীতি অপরিবর্তিত রয়েছে।

বরং মাওসেতুং-এর মৃত্যুর পর চীন সমাজতান্ত্রিক আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে। সুতরাং ৩১ আগস্টকে আমাদের কালো এবং ঘৃণ্য দিবস হিসাবেই মনে রাখতে হবে। আর একটি কৌতুহলি ব্যাপার হলো, “যারা মুসলমানদের স্বার্থ কোথাও বিঘ্নিত হলে সরবে ফেটে পড়েন তারা কিন্তু চীন সরকারের দ্বারা উইঘুর মুসলমানদের গণহত্যার ব্যাপারে নীরব।” শুধু মুসলিম নিধনই নয়, বিশ্বস্ত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর ও তথ্য অনুযায়ী সেখানে ২০ লক্ষ উইঘুর মুসলমানকে অন্তরীণ করে রাখা হয়েছে, চালানো হচ্ছে বহু ধরনের নির্যাতন। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্ববাসীদের সময়ক্ষেপণ না করে চীনের মতলব জানতে হবে, যাতে আমরাও শ্রীলঙ্কা, জিবুতির মতো চীনের ফাঁদে না পড়ি।

লেখক:: সুপ্রীম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক।

Development by: webnewsdesign.com