করোনায় যেসব বিশিষ্টজনদের হারাল বাংলাদেশ

শনিবার, ১৩ জুন ২০২০ | ৮:৫৫ অপরাহ্ণ

করোনায় যেসব বিশিষ্টজনদের হারাল বাংলাদেশ

দেশে চরম রূপ ধারণ করেছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। প্রতিদিনই আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলছে। বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত হয় ৮ই মার্চ। আর আজ ৮ জুন ৩ মাসে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৮ হাজার ৫০৪ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় সনাক্ত হয়েছে ২৮৫৬ জন এবং মারা গেছেন ৪৪ জন। আক্রান্তের সংখ্যায় এবার চীনকে ছাড়িয়ে গেল বাংলাদেশ। আজ ১৩ জুন বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮ নম্বরে।

এ পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৪ হাজার ৩৭৯ জন আর মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৩৯ জন। যদিও প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে বেশি বলে দাবি বিশেষজ্ঞদের। করোনায় সাধারণ মানুষের পাশাপাশি মারা গেছেন অনেক বিশিষ্টজন, পুলিশ, ডাক্তার, সাংবাদিক। তাঁদের স্মরণেই এই আয়োজন।

ড. আনিসুজ্জামান : দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, লেখক ও জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান গত ১৪ মে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তার মৃতদেহ থেকে নমুনা নিয়ে করোনা পরীক্ষা করা হলে জানা যায় তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত একুশে ও স্বাধীনতা পদক এবং ভারত সরকারের পদ্মভূষণ সম্মান অর্জন করেছেন। বর্ষীয়ান এই বুদ্ধিজীবীকে হারিয়ে বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা অনেকটাই ধাক্কা খেয়েছে।

মোহাম্মদ নাসিম : আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমও করোনাভাইরাসের শিকার হয়েছেন। ১ জুন জ্বর-কাশিসহ ঢাকার একটি হাসপাতালে ভর্তি হলে মোহাম্মদ নাসিমের করোনা ধরা পড়ে। এরপর শুক্রবার ভোরে তিনি ব্রেনস্ট্রোক করেন। হাসপাতালের নিউরো সার্জন অধ্যাপক রাজিউল হকের নেতৃত্বে সফল অস্ত্রোপচার হলেও তিনি কোমায় চলে যান। পরবর্তীতে তার তিনবার করোনা পরীক্ষা হলেও নেগেটিভ রিপোর্ট আসে বলে জানানো হয়। অবশেষে সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে ১৩ জুন রাজপথের সংগ্রামী এই নেতা পাড়ি জমান না ফেরার দেশে।

ডা. মঈন উদ্দিন : সিলেটের এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মঈন উদ্দীন গত ১৫ এপ্রিল করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। করোনায় মৃত দেশের প্রথম ডাক্তার তিনি। তাঁর মৃত্যুর ঘটনায় দেশব্যাপী ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়। কারণ ডাক্তার হয়েও তিনি সিলেটের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) সুযোগ পাননি। মৃতপ্রায় অবস্থায় ঢাকায় আসতে একটি বিশেষায়িত অ্যাম্বুলেন্স চেয়েও পাননি করোনা যুদ্ধের এই সন্মুখযোদ্ধা। এর আগে পিপিইর অভাবে সাধারণ পোশাকেই রোগী দেখেছেন ডা. মঈন। তার মৃত্যু দেশের রুগ্ন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে নগ্ন করে দিয়েছিল।

ভিসি ড. নাজমুল করিম: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ড. নাজমুল করিম গত ৭ মে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেন আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়।

সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী আনোয়ারুল কবির: বিএনপি জোট সরকারের আমলের সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী আনোয়ারুল কবির করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ১০ মে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ)  মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। তিনি বিএনপির সাবেক মহাসচিব ব্যারিস্টার আবদুস সালাম তালুকদারের ভাতিজা।

হেমাটোলজিস্ট অধ্যাপক মনিরুজ্জামান: দেশের অন্যতম হেমাটোলজিস্ট এবং ল্যাবরেটরি মেডিসিন স্পেশালিস্ট অধ্যাপক কর্নেল (অব.) মো. মনিরুজ্জামান করোনাভাইরাসের শিকার হয়ে গত ৩ মে বিকাল সাড়ে পাঁচটায় মৃত্যুবরণ করেন। করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারানো দেশের দ্বিতীয় চিকিৎসক তিনি। ড. মো. মনিরুজ্জামান আনোয়ার খান মডার্ন মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের চিফ হেমোটোলজিস্ট ছিলেন। পেশাগত কাজ সেরে বাসায় ফিরে ইফতারের আগে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নেওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তাৎক্ষনিক কোভিড-১৯ পরীক্ষা করা হলে ফলাফল পজিটিভ আসে।

দুদক পরিচালক জালাল সাইফুর রহমান: করোনার আগ্রাসনের শুরুতে গত ৬ এপ্রিল করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পরিচালক জালাল সাইফুর রহমান মারা যান। তিনি রাজধানীর কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। জালাল সাইফুর রহমান । বিসিএস ২২তম ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা ছিলেন।

সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর খোকন: দৈনিক সময়ের আলো পত্রিকার নগর সম্পাদক হুমায়ুন কবীর খোকন গত ২৮ এপ্রিল রাত ১০টার দিকে উত্তরা রিজেন্ট হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। মৃতের নমুনা সংগ্রহ করে কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য আইইডিসিআরে পাঠানো হয়েছিল। ২৯ এপ্রিল বিকাল পৌনে চারটার দিকে আসা রিপোর্ট থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন।

নিলুফার মঞ্জুর : ২৪ মে মারা যান সানবিমস স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা নিলুফার মঞ্জুর। তিনি ১৯৭৪ সালে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সানবিমস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। দেশ-বিদেশে এই স্কুলের হাজার হাজার শিক্ষার্থী বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অ্যাপেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর স্ত্রী।

রেফারি হুমায়ুন কবীর জুয়েল : করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ২৬ মে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান ক্রীড়াঙ্গনের মেধাবী মুখ এশিয়ান কারাতে ফেডারেশনের রেফারি ও বাংলাদেশ কারাতে ফেডারেসনের সদস্য হুমায়ুন কবীর জুয়েল (৫০)। বেসরকারি গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন তিনি।

ডা. মির্জা নাজিম উদ্দিন : করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ৭ জুন রাজধানীর অভিজাত স্কয়ার হাসপাতালের পরিচালক (মেডিক্যাল সার্ভিস) ও সিনিয়র কনসালট্যান্ট মির্জা নাজিম উদ্দিন মারা যান। তিনি বলেন, প্রায় সপ্তাহ দুই আগে থেকে অসুস্থ ছিলেন মির্জা নাজিম উদ্দিন। স্কয়ার হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন ছিলেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর। তাঁর স্ত্রী খালেদা ইয়াসমিন মির্জাও চিকিৎসক। এই দম্পতির দুই ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে।

বিএনপি নেতা আহসান উল্লাহ হাসান : ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আহসান উল্লাহ হাসানও গত ৭ জুন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৫৫ বছর। গুলশানের শাহাবউদ্দীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।

সাংবাদিক আবদুল মোনায়েম খান : করোনার শিকার হয়ে গত ৭ জুন মারা যান কক্সবাজারের সিনিয়র সাংবাদিক আবদুল মোনায়েম খান। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রবিবার বিকেল ৩টার দিকে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার, নিউ এজ, ডেইলি সান পত্রিকার পর মৃত্যুকালীন ডেইলি ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেসের কক্সবাজার জেলা প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

শিল্পপতি আজমত মঈন : দেশের চা-শিল্পের খ্যাতিমান ব্যবসায়ী বিশিষ্ট শিল্পপতি আজমত মঈন করোনায় আক্রান্ত হয়ে গত ৬ জুন রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর। তিনি মৌলভী চা-কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান, সুরমা চা-কোম্পানির পরিচালক ছিলেন।

সাবেক সচিব এম বজলুল করিম চৌধুরী : করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সাবেক সচিব এম বজলুল করিম চৌধুরী গত ৩১ মে রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালে মারা গেছেন। তিনি বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) ১৯৮৫ ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা ছিলেন। বজলুল করিম টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক, রাজউকের চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার (পিআরএল) পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।

সুন্দরবন কুরিয়ারের প্রতিষ্ঠাতা মো. ইমামুল কবীর শান্ত : এই মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন শান্তা মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি ও সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস (প্রা.) লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা মো. ইমামুল কবীর। গত ৩০ মে সকাল ৮টার দিকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

মোস্তফা কামাল সৈয়দ : বাংলাদেশ টেলিভিশনের অবসরপ্রাপ্ত উপমহাপরিচালক, বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এনটিভির উপদেষ্টা (অনুষ্ঠান), এনটিভির অনুষ্ঠান বিভাগের প্রধান মোস্তফা কামাল সৈয়দ গত ১ জুন গতকাল রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে করোনার আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর।

রূপালী ব্যাংকের উপ-মহাব্যবস্থাপক সহিদুল ইসলাম খান : করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন রূপালী ব্যাংকের প্রধান কার‌্যালয়ের পরিকল্পনা ও গবেষণা বিভাগের উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) সহিদুল ইসলাম খান মৃত্যুবরণ করেছেন। তার বয়স হয়েছিল ৪৯ বছর। গত ১৫ মে রাজধানীর কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

Development by: webnewsdesign.com