আমি যুদ্ধ দেখেনি, বিজয় দেখেছি

শুক্রবার, ২০ মার্চ ২০২০ | ৯:২৩ অপরাহ্ণ

আমি যুদ্ধ দেখেনি, বিজয় দেখেছি

শরতের সকালে এক পশলা বৃষ্টি। কিছুক্ষন পরে পরিষ্কার হয়ে গেছে আকাশ। বিকেলে ইন্দ্রজীতদের বাড়ির আঙ্গিনায় মার্বেল খেলতে ব্যস্ত ছিলাম। মার্বেলের জৈন খেলায় দান ধরে সকল মার্বেল হিোয়ছি নিখিল, তপেন্দ্র ও চিত্তরঞ্জনদের কাছে। শূন্য হাতে দর্শক সেজে বসে আছি তাদের পাশে। প্রতি আনায় ৭টি মার্বেল ধরে আট আনার মার্বেল কিলাম। খেলা আবার শুরু হলো। হঠাৎ বড়দের মধ্যে হৈ হুল্লোর রব। গ্রামে পাঞ্জাবীরা আক্রমন করবে। সবাই ভারতে যাবার দুশ্চিন্তায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল। কখন যে হানা দেয় পাঞ্জাবীরা। আমাদের খেলাধূলা অভিভাবকরা পন্ড করে দিল। এভাবে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। বাড়ির পূর্ব দিকে একটি নৌকা ভিড়ল। ল্যান্টনের আলো দেখানোর জন্য শুরু হলো চিৎকার। তারা অন্য কেউ নয়। আমার মামা মতিলাল ও উমেশ সরকার। শাল্লা উপজেলার হবিবপুর গ্রামের বাসিন্দা। পাঞ্জাবীদের আক্রমনের স্বীকার হয়ে ভারতে যাবার জন্য আমাদের বাড়িতে তাদের আগমন।

গভীর রাত। গ্রাম জুড়ে ভয়ানক পরিস্থিতি। পালাক্রমে পাহারা দিচ্ছে ১০ জন করে। খুব ভোরে আমার বাবা দিগম্বর পুরকায়স্থ প্রতিবেশী কাকা মহারাজ ও যুধিষ্টি সরকারকে নিয়ে পাকনার হাওর থেকে একটি ভাড়াটে নৌকা নিয়ে আসলেন। ইতিপূর্বে বেশ কয়েকজন যুবক জ্ঞান রঞ্জন, শশী মোহন, অনিল, নিবরস, কালী কুমার তারা চলে গেছে মুক্তিযুদ্ধে। অনেকে বলাবলি করছে এখন আর গ্রাম ছাড়তে হবেনা। আমাদের মুক্তিযোদ্ধরা আমাদেরকে রক্ষা করবে। তবুও আমার বাবা ঘাটে নৌকা ভিড়িয়ে বিভিন্ন মালামাল তুলতে শুরু করলেন।

রান্নাঘরে চলছে কান্নার রোল। একি! হৃদয় বিদারক দৃশ্য! বাবা বললেন হায়রে বিধি, জানিনা কি আছে কপালে। দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি বনবাসে। কে কোথায় যাবে? কে বাঁচবে, কে মরবে একমাত্র ভবিতব্যই জানেন। কিছুক্ষণ পর পার্শবর্তী লক্ষীপুর গ্রামের আমার বাবার বন্ধু গাজীউর রহমান অনেক অভয় দিলেন। গোলা ভর্তি ধান, গোয়াল ভরা গরু, কাঠের, খুঁটির তৈরী কয়েকটি টিনের ঘর তথা একজন গৃহস্থ পরিবারের গৃহস্থালীর সব রকম উপকরণ তিনি সমজিয়ে নিলেন। ভারতে যাবার জন্য আমার বাবার প্রস্তুতি দেখে গ্রামের অনেকেই গুটিয়ে নিচ্ছেন অস্থাবর সম্পত্তি। আমার বড় ভাইয়ের কেমি ঘড়িতে দুপুর ১২টা ১৫। হঠাৎ গ্রামের চারদিকে কয়েকটি নৌকা টহল দিচ্ছে। মুক্তিবাহিনী! নাকি পাঞ্জাবী কেউ জিঞ্জেস করার সাহস পাচ্ছেনা। গ্রামের জনজীবন নিরব নিঃস্তব্ধ। আমরার ৫ ভাই, ২ বোন, মা-বাবা ও আমার ঠাকুরমা সহ মামাদের পরিবার ও প্রতিবেশীদের পরিবার নিয়ে বেশ কয়েকজন। নৌকায় সরঞ্জাম উঠানো হলো।

বাকী রইল বিদায়ের পালা। আমি পিতা-মাতার সর্ব কনিষ্ট সন্তান। আমার চোখে মুখে তথটা কান্নার ভাব না থাকলেও বিষয়টা যে খুব কষ্টকর তা আমি আঁচ করতে পেরেছি। এই সময়ের ভেতরে অনেক দৃশ্যের অবতারনা ঘটলো। এভাবে ঘন্টা দুই পেরিয়ে গেল। পাঞ্জাবীদের রাতের হামলা থেকে বাঁচাতে নৌকায় উঠার তাগদা দিচ্ছেন বাবা। মা শশী রানী একবার নৌকায় পানি ছিটিয়ে ভক্তি করেন, আবার ফিরে যান বাড়িতে। প্রনাম করেন তুলসী বেদীতে। বিদায় নেন গোয়ালের গরুর দিকে চেয়ে। মায়ার কান্নায় মায়ের আঁচল সিক্ত হয়ে গেছে। নৌকার মাঝি মাল্লাদের কড়া তাগিদ। সঠিক সময়ে একটি গ্রামে আশ্রয় নিতে হবে। পৈত্রিক ভিটা ও মাতৃভূমি ছেড়ে চলেছে আমাদের শরনার্থীদের নৌকা। যখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল তখন বর্তমান বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের পাচঁহিস্যা গ্রামের কাছে পৌঁছেছি। নৌকার ছাদের উপরে বাবার শখের চেয়ার টেবিল সহ ঝুলানো কিছু আসবাবপত্র। নৌকায় পাল তুলতে বা গ্রামের সাঁকোর নিচ দিয়ে পাড়ি দিতে অসুবিধার কারণে সেই আসবাবপত্রগুলো মাঝি মাল্লারা যেখানে সেখানে ফেলে দিচ্ছে। এতে বাবার চোখে মুখে কষ্টের ছাপ পরিলক্ষিত হচ্ছে। আগামীকাল ভারতে মৈলাম ক্যাম্পে পোঁছতে হবে। মৈলাম পোঁছার আগে ৫ মাইল পূর্বে নৌকা আটক করে দেয় ভারতীয় আইন শৃঙ্খলা কমিটি সদস্যরা। আটক করার পর প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম প্রত্যেকেই যার যার হাতে করে মৈলাম গিয়ে পৌঁছলাম।

মৈলাম ক্যাম্পের ওপারে বালাট। বালি আর বালিতে মরুময় সেই ভূমি। লক্ষ লক্ষ মানুষের ভীড়। শরনার্থী বলতে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক ছাড়া ভিন্ন ধর্মের লোক নেই। সারি সারি লম্বা কাঁচা বাঁশের ঘর। কুচ পাতার ছাউনী। ট্রাক ভরে কুচ পাতা আর মুলি বাঁশ নিয়ে ঐক্যবদ্ধ একটি শ্রমিকদল গৃহনির্মাণ কাজে ব্যস্থ আছে। আমরা যেখানে ছিলাম তার নাম ৮নং মৈলাম ক্যাম্প। রাতের ভিতরেই গৃহনির্মাণ করে বসবাস শুরু হয়েছে। পরদিন আমার গৃহের পার্শ্বে বালির মাঠে রেশন নিয়ে হাজির হয়েছে ভারতীয় হেলিকপ্টার। লাইন ধরে চাল-ডাল সহ সছমান আর সিলভারের মগ ভরে দুধ নিয়ে আসলাম। টা-টা করে ঘুরে বেড়ানোই ছিল আমার অভ্যাস। কচি বাঁশ আর কুচ পাতার ঘরগুলো বালি আর বালির উপর দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিদিন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে অসংখ্য মৃত লাশ বালির উপর ফেলে রেখে যায় কে বা কারা? কারো অশ্ররোদনের সময় নেই। বালির উপর সুর্যের উত্তাপ জনজীবনকে দূর্বিষহ করে তুলে। বড় ভাই দিজেন্দ্র পুরকায়স্থ (৫ মার্চ ২০১৯ মৃত্যু হয়েছে) গৃহনির্মাণের টিকাদারি কাজের জন্য ব্যথিব্যস্থ সময় কাটাচ্ছেন। বড় ভাই মন্টু ও ননি গোপাল হাটছেন রেশন সংগ্রহ ও ব্যবসার সন্ধানে। ইমিডিয়েট বড় ভাই কৃষ্ণকান্ত পারিবারিক প্রয়োজনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এখানে সেখানে। শুধু খাবারের সময় ছাড়া আমাকে খুঁজে পাওয়া কারো সাধ্য নেই। সকাল ৮টা থেকে আমার ছোট মামা পার্শ¦বর্তী পার্বতী নামক পাহাড়ে জ্বালানী কাঠ সংগ্রহ করতে আমি সঙ্গে ছিলাম। মামার হাতে কুড়াল আমার হাতে দা। উঠতে থাকলাম পাহাড়ের দিকে। খানিকটা উপড়ে উঠতেই কেঁপে উঠল পাহাড়। হাজারো মানুষের কন্ঠে ধ্বনিত হলো শারফিন শারফিন বলে।

উফ্! সেই ভয়ঙ্কর ভয়ের কথা ভুলতে পারিনি আজও । কিছু জ্বালানী কাঠ মাথায় নিয়ে ক্যাম্পের দিকে আসতে শুরু করলাম। দেখতে পাচ্ছি বড় বড় আগুনের ফুলকা উড়ছে। শুনতে পাচ্ছি ৮ নং ক্যাম্পে আগুন লেগেছে। লাকড়ি ফেলে মামার সঙ্গে দৌরে পৌঁছলাম ক্যাম্পে। ততক্ষনে কোন রকম সকলে মিলে ঠাকুর মা ও দিদি মাকে আগুনের ফুলকা থেকে উদ্ধার করতে পেরেছি, সেই সাথে কিছু সরঞ্জামাদিও। মোহুর্তেই ৮নং ক্যাম্পে চার শতাধীক কুঠির পুড়ে ছাড়কার। বিভৎস্য চেহারা ক্যাম্পের। অসহায় শরণার্থীরা যার যার সুবিধাজনক স্থানে আশ্রয় নিচ্ছে। ভারতীয় হেলিকপ্টার বিপুল পরিমানে ত্রাণ সামগ্রি নিয়ে ফেলে দিল খোলা মাঠে। তাবু তৈরীর জন্য ত্রিপাল ফেলেছে অসংখ্যা ভান্ডিল। সুষ্টু ব্যবস্থাপনার অভাবে যে যার সাধ্য সংগ্রহ করেছে। এত সহযোগীতার পরও পরিবেশগত কারণে মৃত্যুর বিভীষিকা ছিল সবার জন্য আতঙ্কময়। আমাদের কলনীর একাংশে ছিল আমাদের গ্রামের অশ্বিনী ও নবরঙ্গদের পরিবার। জলজীবের (কচ্ছপ) ব্যবসা করত তারা। আগুনে পুড়ার পর চলে এলাম কাঁঠাল বাড়ি নামক স্থানে। তখন যোদ্ধের দামামা প্রায় শেষ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষনার সাথে সাথে বড় ভাই একা এলেন দেশে। দেখলেন ঘর-দরজা বলতে কিছু নাই। মাত্র সাড়ে পাঁচ মাস ভারতে থেকে পরিবারের সাথে পায়ে হেঁটে দেশের মাটিতে প্রবেশ করলাম। কাঁঠাল বাড়ি থেকে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার চিনাকান্দি বাজার হয়ে ফতেহপুর নদী পাড়ি দিয়ে পৌঁছলাম জামালগঞ্জের লামা বাজারের ফেঁরীঘাটে। এরই মধ্যে পথে পথে দৃশ্যমান হলো অনেক হিন্দু গ্রামের ধ্বংশ লীলা। বর্তমান মাছ বাজারের পুরোটাই ছিল পাঞ্জাবীদের ব্যাঙ্কার। বর্তমান সাচনা বাজার ও মাছ বাজারের মধ্যবর্তী পিয়াইন নদীর উপরে ছিল একটি ব্রীজ। বর্তমানে ব্রীজের নিচে গড়ে উঠেছে নিউ মার্কেট। সেই ব্রীজ চৈকী পাক সেনাদের ব্যাংকার দেখতে সর্বদাই থাকত মানুষের ভীড়। ব্যাংকারের ভিতরে ছিল অসংখ্য খাটিয়া। চারিদিকে ছিল কলা গাছের স্তোপ ও বালি ভর্তি বস্তা। সম্ভবত মুক্তিযোদ্ধাদের গুলির আঘাত থেকে সুরক্ষার জন্যই ছিল এই পরিকল্পনা।

ব্যাংকারের দৃশ্য দেখার পর বাজারের বড় ব্যবসায়ী আব্দুর রহমান সাহেবের বিল্ডিংয়ের বারান্দায় অন্য শরণার্থীদের অপেক্ষা করছিলাম আমরা। তারপর সুরমা নদী পাড়ি দিয়ে জামালগঞ্জ থানা ঘেঁষে শাহাপুর হয়ে দৌলতা নদী পাড়ি দিয়ে কানাইকালি নদীর তীরে আমার বিনাজোড়া গ্রামে পৌছিলাম। সেখানে বসতভিটা স্থাপনের কোন চিহ্ন নেই। বসত ভীটার উপর অনেক দুর্বা ঘাষ কেঁটে বাঁশ পুতে ছাউনী দিয়ে কেটেছে কয়েক রাত। এরপর থেকে বঙ্গবন্ধুর বিধ্বঃস্ত বাংলাদেশ গড়তে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী সহ সরকারি বেসরকারি দেশপ্রেমিক ও কর্মকর্তারা অবকাঠামোর উন্নয়নে তাদের কাজ সবে শুরু করেছে। এভাবে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের ভয়াবহ চিত্র ছিল নিত্য সঙ্গি। ১৯৭৪ সালের জুলাই মাসে প্রচন্ড বন্যায় উত্তাল তরঙ্গে দেশ ভাসচ্ছে। হাওরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চল অপূরনীয় ক্ষতি হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বঙ্গ বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যার সংবাদ রেডিও তে প্রচার হচ্ছে। মনে পরে ঐ দিন বর্তমান শাল্লা উপজেলার চাকুয়া গ্রামের কন্ঠ শিল্পী রাখাল চক্রবর্তী আমাদের গ্রামে নিরজ্ঞন সরকারের আম গাছের নিচে গানে ঠান দিলেন, মুজিব বাইয়া যাওরে- নির্যাতিত দেশের মাঝে তোমার ভাঙ্গা নাও । কিছু পরেই সবাই কে বললেন মুজিব আর দেশের উন্নয়নের নৌকা বাইতে পারবে না । ঘাতকরা তাকে হত্যা করে ফেলেছে

Development by: webnewsdesign.com